আমি ঘরের চারপাশটা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে নিলাম (আমার দুচার মিনিট দেরি হয়েছিল আসতে) পোয়ারো বসে আছে মিঃ ভ্যাইসের ডান পাশে। নীচু গলায় কি যেন বলছে পোয়ারো ওকে। এলিন দরজার পাশেই একটা টুলে বসেছে। ওর পাশে ওর স্বামী। ভদ্রলোক বড়বড় শ্বাস নিচ্ছেন। বেশ নার্ভাস। ফ্রেডরিকা, লাজারুম, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার বাকিরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরো ঘরটা জুড়ে বসেছিল। ওদের সবার থেকে কিছুটা দূরে বসেছিলাম আমি।
দেখা গেল, পরিচালক হলেও পোয়ারো সক্রিয়ভাবে নাটকের পরিচালনায় অংশ নিচ্ছেন না। সেই দায়িত্বটা ও দিয়েছে চার্লস ভ্যাইসকে। এতক্ষণ ধরে বোধ হয় সে সবই বোঝাচ্ছিল ওনাকে। পোয়ারো যে তার আস্তিনের তলায় আমাদের জন্যে কি অবাক করা কাণ্ড লুকিয়ে রেখেছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
যুবক আইনজীবীটি সামান্য কেশে, গলা সাফ করে নিয়ে বলতে শুরু করে এই জমায়েতটা একটু অন্য ধরনের। পরিস্থিতিটা সত্যিই ভীষম রকমের অদ্ভুত। বলা উচিত চমকপ্রদ। আমার তুতো বোন নিকের মৃত্যু ঘিরে এক আশ্চর্য পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তার মৃত্যুর পর ময়না তদন্ত চলছে, মৃত্যু হয়েছে খুনের উদ্দেশ্যে। বিষ প্রয়োগে, কে, কিভাবে বিষ প্রয়োগ করেছে সেটা পুলিশই তদন্ত করে খুঁজে বার করবে। আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমার যেটা বলবার কথা, যা বলতে এখানে এসেছি সেই কথাই বলি। যে কোন মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছাপত্র তার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার পরই পড়তে হয়। কিন্তু মিঃ পোয়ারোর সনির্বন্ধ অনুরোধে এবং বিশেষ কারণে আমি নিকের অন্ত্যেষ্টি কাজ সম্পন্ন হবার আগেই তার শেষ ইচ্ছাপত্রটি খুলে পড়ছি। যার যা প্রাপ্য এই সম্পত্তি থেকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সেকারণেই আজ রাতে সবাইকে এখানে জমায়েত হতে বলেছি। আর এই উইলটাও ভারী অদ্ভুত ভাবে আমার কাছে পৌঁছেছে। এটার তারিখ লেখা আছে, ফ্রেব্রুয়ারী মাসের। অথচ, আশ্চর্য দেখুন, এটা মাত্র আজ সকালেই আমার কাছে পৌঁছেছে। যদিও, কোন সন্দেহই নেই যে উইলটা আমার বোনের হাতেই লেখা। এবং আইনিভাবে তৈরি। ভ্যাইস একটু থামে।
আরও একবার গলা সাফ করে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে। ঘরের প্রতিটি মানুষের চোখ তখন ওর ওপর নিবদ্ধ এটা খুবই ছোট্ট’। হাতের হলুদ রঙের মোটা খামটা থেকে একটা কাগজের পাতা বের করে, সামান্য বিরতির পর সে পড়তে শুরু করে এটা ম্যাগডেলা বার্কলির সম্পত্তির বাটোয়ারা বিষয়ে শেষ ইচ্ছাপত্র। আমি নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি আমার সম্পত্তির সঠিক ভাগ-বাটোয়ারা দায়িত্বে থাকবেন আমার তুতো ভাই চার্লস ভ্যাইস।
আমার শেষ ইচ্ছানুসারে আমার স্থাবর অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হবেন আমার মৃত্যুর পর মিসেস মিলডেরড ক্রফট। আমার বাবাকে দারুণভাবে সঙ্গদান ও সেবা করার জন্যে, বন্ধুত্বর সামান্য নিদর্শন হিসাবে তার প্রতি আমার প্রতিদান। আমার বাবা ফিলিপ বার্কলির হয়ে আমি মিসেস ক্রফটকে তার সার্ভিসের অতুলনীয় উপকারের বিনিময়ে সামান্য কিছুটা ফিরিয়ে দিতে চাই।
সই– ম্যাগডেল বার্কলি।
সাক্ষী– এলিন উইলসন, উইলিয়াম উইলসন’ ভ্যাইস থামলেন।
আমি স্তব্ধ, নির্বাক হয়ে গেলাম। ঘরের প্রতিটি মানুষেরই অবস্থা আমারই মত। শুধুমাত্র মিসেস ক্রফট বারকয়েক সমর্থনসূচক ভঙ্গিতে মাথাটা নাড়ালেন। এটা সত্যি। শান্ত গলায় বললেন তিনি। ফিলিপ বার্কলি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন। এবং সেটা মনে হয় আমারই জন্যে। যাইহোক, সেই বিষয়ে আমি কিছু বলব না। এতদিন যখন কাউকে কিছু বলিনি, আজও কিছু বলব না। গোপন বিষয় গোপনই থাকুক। যদিও, এখন দেখছি নিক ব্যাপারটা জানত। খুব সম্ভবত ওর বাবা ওকে জানিয়েছিলেন। আমরা যে বারবার এখানে আসতাম সেটা এই এন্ড হাউসকে দেখতে কাছ থেকে, ফিলিপ বার্কলির মুখে সব সময় যেটার কথা বহুবার শুনেছিলাম। নিক সব জানত তাই বারবার আমরা এখানে আসি ও চাইত। লজটায় আমাদের থাকতে দিত। ভাড়া নিতে চাইতনা এক পয়সাও। আমরা প্রায় জোর করেই ভাড়াটা দিতাম। কিন্তু ও নানাভাবে সেটা আমাদের ফেরত দিয়ে দিত। আর শেষ পর্যন্ত, এই পৃথিবীতে নাকি কৃতজ্ঞতাবোধ বলে কিছু নেই। ভুল, ভুল। এই ঘটনাটাই তো জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ, নিকের মত মানুষদের মধ্যে, তা বেঁচে আছে, থাকবে।
সারা ঘরে তখনও তারপরও এক বিস্ময় বিজড়িত নৈঃশব্দ। পোয়ারো ভ্যাইসের দিকে তাকায় আপনার এই ব্যাপারে কোন ধারণা ছিল?
ফিলিপ বার্কলি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন আমি জানতাম। কিন্তু সেখানে কোনরকম স্ক্যান্ডাল ঘটেছিল বলে শুনিনি কখনও।
পোয়ারো সপ্রশ্ন চোখে মিসেস ক্রফটের দিকে তাকায়। তিনি দৃঢ়ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন নাহ আমার থেকে আপনি কিছু জানতে পারবেন না। সেই গোপনতা আমার সঙ্গেই কবরে যাবে। আগেই বলেছি, অতীতেও এ ব্যাপারে কখনও কারও কাছে মুখ খুলিনি। আজ বা পরেও কোনদিন খুলব না।
ভ্যাইস শান্তভাবে বসে হাঁটুতে পেন ঠুকতে থাকে সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়……
পোয়ারো ভ্যাইসের দিকে ঝুঁকে পড়ে এই উইলটাকে মাদাম জোয়েলের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হিসাবে আপনার আদালতে চ্যালেঞ্জ জানান উচিত। যখন এই উইল তৈরি করা হয়েছিল তখন একরকম ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন এটা বিশাল এক সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ব্যাপার।