আপনার বন্ধু নিক-এর সঙ্গে যতক্ষণ না কথা সেরে নিচ্ছেন ততক্ষণ অন্তত আপনি বসুন।
আমি একবার শ্যালিঙ্গার-এর মুখের দিকে তাকাই, তারপর বলি-মিস বার্কলি খুবই দয়ালু মনের মহিলা। সকালে আমার বন্ধুর গোড়ালিতে চোট লেগেছিল। তখন উনি খুব সাহায্য করেছিলেন।
হুম, নিকও সেকথাই বলেছে।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খোঁজখবর চেষ্টা করে শ্যালিঙ্গার। তারপর বলে–যাক, এখন তো উনি পুরোপুরি সুস্থ আছেন?
কথাটা শুনে আমি কেমন যেন একটু লজ্জিত হলাম, বললাম-হ্যাঁ, সামান্য একটু মচকে গিয়েছিল।
যাক, আমার জেনে ভাল লাগল যে পুরো ব্যাপারটা নিজের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত নয়।
আমি কথাটা শুনে কেমন যেন চমকে উঠি। মানে?
শ্যালিঙ্গার মাথা নাড়েন। মুচকি হেসে বলেন-এসব ব্যাপারে নিক একেবারে তুখোড়, চরম পটু। প্রায় ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতা বলা চলে। নিক একজন মিথ্যাবাদী।
কথাটা আমি হজম করতে পারছিলাম না; ওরকম মিষ্টি একটা মেয়ে।
ও যা সব সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। কেন, আপনাদের কিছু শোনায়নি? হত্যার চেষ্টা, গাড়ির ব্রেক খুলে রাখা……… শেষের দিকে তীব্র ব্যাঙ্গের মত শোনায় শ্যালিঙ্গারের কথাগুলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে পোয়ারো ফিরে আসে। আমি উঠে দাঁড়াই।
পোয়ারো আমার কব্জি চেপে ধরে, ওনাদের অভিবাদন জানিয়ে দ্রুতপায়ে আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলেন। যেতে যেতে শুধু বললেন-সব ঠিক হয়ে গেছে। মাদাম সাড়ে ছ’টায় এন্ড হাউসে আমাদের দেখা করতে বললেন। আপাততঃ উনি এখন মোটর যাত্রায় যাচ্ছেন, আমাদের এখন ওনার ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তুমি ওনাকে কি বললে?
আমি ওনার সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিস্তারিত কথা বলতে চাইলাম। প্রথমটায় উনি ঠিক রাজি হতে চাইছিলেন না। শেষে অবশ্য আমার কয়েকটা কু শুনে কিছুটা অবাক হয়েই রাজি হলেন আমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে।
বিকেল হতে না হতেই পোয়ারোর মনে এক প্রবল অস্থিরতা দেখা দিল। ঘরময় কেমন অস্থিরভাবে সে হেঁটে বেড়াতে লাগল।
ছ’টা বাজতে না বাজতেই আমরা রওনা দিলাম এন্ড হাউস-এর উদ্দেশ্যে।
অবিশ্বাস্য! তাই না হোটেলের বাগান। পাগল না হলে কেউ এরকম জায়গায় গুলি চালাবার ঝুঁকি নেয়?
না, তোমার কথা মোটেই মানতে পারছি না হেস্টিংস।
আবার একটু ভেবে দেখলে, এর থেকে নিরাপদ জায়গা আর হতে পারে না। প্রথমতঃ বাগান একেবারে নির্জন। দ্বিতীয়তঃ হোটেলে যারা আসে তারা বারান্দায় বসে সমুদ্র এবং বেলাভূমির সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়ে ওঠে। সেইসময় বাগান থেকে কেউ যদি সেই সৌন্দর্যপিপাসুটিকে গুলির শিকার করতে চায় খুবই সহজ ব্যাপার।
আমি অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ঠিক, পোয়ারো ঠিকই বলছে। লম্বা লম্বা গাছ, উঁচু উঁচু ঝোপ, ফুলের ঝাড়। আততায়ীর লুকিয়ে থাকাটা কোনও ব্যাপারই নয়। এখান থেকে আততায়ী নির্বিঘ্নে কাজটা সারতে পারবে।
সত্যি, ব্যাপারটা খুবই সহজ। আততায়ী জানত যে নিক বার্কলি ওই রাস্তাটা ধরে বাড়ি ফিরবে, তবু ব্যাপারটা কেন যেন বেশ ঝুঁকির মনে হচ্ছে আমার। গুলি করে খুন করাকে তো আর দুর্ঘটনা বলে চালানো যাবে না।
আমরা পৌঁছে গেলাম এন্ড হাউসে। আমাদের সামনে পাহাড়ের বাঁকে। শীর্ষদেশে ভেসে উঠল একটা ফটক; যার মাথায় ছোট্ট অক্ষরে লেখা এন্ড হাউস। ফটকের ভিতর প্রবেশ করে সরু গলি ধরে আমরা এসে হাজির হলাম ছোট্ট একটা বাগানে। বিভিন্ন ধরনের ফুলের ঝাড় আর ঘাসে ছাওয়া সুদৃশ্য বাগান সংলগ্ন ছবির মত সুন্দর একটা বাড়ি, যার জানালাগুলো সুন্দর পর্দায় ঢাকা। আমাদের পায়ের শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়সী এক বৃদ্ধ। ফুলের ঝাড় পরীক্ষা করছিলেন তিনি। প্রায় ছ’ফুট লম্বা, পরনে রংচটা জ্যাকেট, মাথা প্রায় ফাঁকা, তবে দু’চোখের চাউনি আশ্চর্য ধরনের।
শুভ সন্ধ্যা। আমাদের দিকে তাকিয়ে অভিবাদন জানালেন।
আমি প্রত্যুতরে অভিবাদন জ্ঞাপন করে ভেতরের দিকে এগোতে লাগলাম। যদিও বুঝতে পারছিলাম আমাকে কেউ যেন অনুসরণ করছে।
আশ্চর্য। পোয়ারো চিন্তান্বিত গলায় বলল।
আমরা বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বেশ পুরানো আমলের বাড়ি। দুর্গের আকারে এই বাড়ি। তবে প্রায় ভগ্ন দশা। মেরামত হয়ই না।
মধ্যবয়সী এক মহিলা দরজা খুলে দিলেন। সেই জানাল যে, মিস নিক বার্কলি এখনও ফেরেননি।
পোয়ারো জানাল মিস বার্কলির সঙ্গে তার আগে থেকেই সময় স্থির করা আছে এবং সে ওনার জন্যে অপেক্ষাও করবে।
আমরা ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পর্দাগুলো সুদৃশ্য–দামী ব্রোকেডের, কিন্তু পুরানো। ঘরের আসবাবপত্রগুলোও সবই পুরানো দিনের। দেওয়ালে বহু বছর নতুন রঙ পড়েনি। তবে সোফা এবং টেবিলের ঢাকনাগুলো সবই ঝকমক করছে, যেন নতুন। ঘরের দেওয়ালগুলো জুড়ে বালি পরিবারের পূর্বপুরুষদের তৈলচিত্রা ঘরে একটা তারবিহীন ফোনও রয়েছে। সোফার কোণে দরকরচা মেরে পড়ে আছে একটা খবরের কাগজ। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ঘরের দরজা হাট করে খুলে গেল। মিস বার্কলি ঘরে ঢুকলেন। ঠান্ডা বরফ নিয়ে এস এলিন। বেশ চড়া গলায় বললেন তিনি। তারপর আমাদের দিকে ওনার নজর পড়ল।
ওহ, আপনারা! আমি এসে পড়েছি। তবে আপনার প্রবল কৌতূহল দেখে আমি অবাক হচ্ছি বটে।