পোয়ারোর কথা শেষ হওয়া মাত্র ফোনটা বেজে উঠল। পোয়ারো ফোনটা ধরা মাত্র দেখলাম নিমেষে পোয়ারোর মুখের ভাব পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। আমার চোখ থেকে নিজের উত্তেজনা আড়াল করতে পারে না ও। ফোনালাপে পোয়ারোর অবদান কিছুই ছিল না বলতে গেলে। মনোযোগ দিয়ে অন্য পক্ষের কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে শুধু সাড়াবোধক শব্দ করছিল সে। ফলে বার্তার কিছুই আমার কানে পৌঁছল না, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কি বিষয়ে ওই চমকদার ফোনটা।
শেষ পর্যন্ত একসময় বাক্যালাপ শেষ হল। Tnes bien, Jeaouses remerei বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে পোয়ারো, আমি যেখানে বসেছিলাম, সেখানে ফিরে আসে। ওর দুচোখে উত্তেজনা চকচক করছিল।
Mon ami পোয়ারো অস্ফুটে বলতে বলতে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে, তোমায় কি বলেছিলাম? এবার ঘটনা ঘটতে শুরু করবে।
কি হয়েছে?
মিঃ চার্লস ভ্যাইস ফোন করেছিলেন। তিনি জানালেন আজ সকালে ডাক মারফত তিনি তার বোনের করা একটি উইল পেয়েছেন। যেটা গত ফেব্রুয়ারি মাসের বানানো।
কি?
একেবারে নিখুঁত সময় ওটা পৌঁছেছে। কি বল?।
আমি ভুরু কুঁচকে তাকাই তোমার কি মনে হয়? উনি সত্যি বলছেন?
পোয়ারো হাসে এই তো সবে শুরু বন্ধু। মাদাম জোয়েল নিক মারা গেছেন। এখন নতুন নতুন এরকম অবাক করা কত কাণ্ডকারখানা ঘটবে। শুধু দেখে যাও।
সত্যিই তাই। তা নতুন উইলের বিষয়বস্তু কি?
মিঃ ভ্যাইস সেসব কিছু বললেন না বিস্তারিতভাবে। সেটাই উচিত। তবে এটা যে নিজের বলা উইলটাই, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ এটার সাক্ষী হিসাবে শ্রীমতী এলিন উইলসন এবং তার স্বামীর সই ছিল।
পোয়ারো একঝলক কি যেন ভেবে নিয়েই দ্রুত পায়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। আমি মাদাম জোয়েল ম্যাগির চিঠিটা আর একবার পড়তে চাই। আমার কি একটা ব্যাপার যেন নজর এড়িয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কৌতূহল উদ্দীপক কিছু একটা। চিঠিটা তুলে নিয়ে পোয়ারো আরও একবার পড়তে থাকে।
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াতে থাকা ইয়টগুলোর পাল্লাবাজি দেখতে থাকি। হঠাৎ পোয়ারোর মুখ থেকে বের হয়ে আসা প্রবল বিস্ময়তাড়িত একটা শব্দে আমি মুখ ফিরিয়ে তাকাই। পোয়ারো দু হাতে তার মাথাটা চেপে ধরে আছে। ওহ আমি কি অন্ধ হয়ে গেছি? পোয়ারো চাপা আর্তনাদ করে ওঠে।
কি হয়েছে?
কি হয়নি হেস্টিংস? কি হয়নি? এরকম একটা সরল ব্যাপার কি করে নজর এড়িয়ে গেল? কিচ্ছু দেখতে পেলাম না আমি? কিছু না?
ভগবানের দোহাই পোয়ারো, বল কি হয়েছে?
দাঁড়াও, দাঁড়াও। আবার ব্যাপারগুলোকে, নতুন করে সাজাতে হবে। পোয়ারো টেবিল থেকে তার সম্ভাব্য অপরাধীদের তালিকাটা তুলে নেয়। দ্রুত সেটার ওপর নজর বুলিয়ে চলে। ওর ঠোঁট দুটো নড়তে থাকে। আর তালে তালে সায়ব্যঞ্জক ভঙ্গিতে ওর মাথাটা নড়তে থাকে।
পড়া শেষ হলে পোয়ারো আরাম কেদারাটায় হেলান দিয়ে বসে। ওর দুচোখ বন্ধ হয়ে যায়। গভীর চিন্তায় ডুবে যায় সে।
একসময় একটা গভীর শ্বাস ফেলে উঠে বসে, সোজা হয় সে। আমার দিকে সোজাসুজি তাকায়। প্রিয় মুদ্রাভঙ্গিতে হাত দুটোকে বুকের কাছে জড়ো করে বলে ব্যাস, সব মিলে যাচ্ছে যা-যা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, জট পাকাচ্ছিল, সব খাপে খাপে বসে যাচ্ছে।
তার মানে, তুমি রহস্যের সমাধান করে ফেলেছ? উত্তেজিত গলায় বলি আমি।
হ্যাঁ, প্রায় সবগুলো জট খুলে গেছে। আমার থিয়োরি মোটামুটি ঠিকই ছিল। আর সেই জন্যেই আসল সত্যিটাকে আশ্চর্যভাবে ধোঁয়াটে মনে হচ্ছিল। তবে এখন সবকিছুই জলের মত স্পষ্ট, স্বচ্ছ। একটু থেমে ও আবার বলতে থাকে আমাকে এখন দুটো টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে দুটো প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে। যদিও, তার উত্তরগুলো ইতিমধ্যে আমি জেনে ফেলেছি। এখানে তা জমা আছে। আঙুল দিয়ে নিজের মস্তিষ্কটা দেখায় সে।
আর সেই প্রশ্ন দুটোর উত্তর কখন পাবে তুমি? কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করি। হঠাৎ পোয়ারো উঠে দাঁড়ায়।
হেস্টিংস, তোমার মনে আছে। মাদাম জোয়েল নিক এন্ড হাউসে একটা নাটক করতে চেয়েছিলেন? আজ রাতে আমরা ওখানে সেইরকমই একটা নাটক করব। কিন্তু সেই নাটকের পরিচালক হবে এরকুল পোয়ারো। মাদাম জোয়েল তাতে একটা বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করবেন। পোয়ারো মুচকি হাসে। তুমি তো জান হেস্টিংস, অনেকের মুখেই শুনেছ এন্ড হাউসে নাকি কিছু আছে। সবার কেমন শরীর ছমছম করে। কিন্তু সেই কিছু মানে ভূত-প্রেতাত্মাটাকে কেউ দেখেনি এন্ড হাউসে, আজ দেখবে।
আমি একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পোয়ারো শুরুতেই থামিয়ে দেয় আমাকে, না, না, আমি আর একটা কিছুও বলব না। আজ রাতেই নিজের চোখে কানে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে। তখনই সব জেনে নিও।
দ্রুতপায়, আচমকা ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায় সে।
.
১৯.
পোয়ারোর পরিচালনায় নাটক
এক কৌতূহল-উদ্দীপক জমায়েত। আজ সারাদিনে পোয়ারোর দেখা প্রায় পাইনি বলতে গেলে। এমনকি রাতের খাবারও খেতে আসেনি। ফোনে বলে রাত ন’টায় আমি যেন সরাসরি এন্ড হাউসে চলে যাই। এন্ড হাউসের বাইরের ঘরে পোয়ারোকে ঘিরে সবাই বসেছিল। আমি দেখলাম পোয়ারোর তালিকার ক’ থেকে ছ’ পর্যন্ত সবাই হাজির রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, তালিকার জ’ ব্যক্তিটি (থাকতেও পারে, কে জানা নেই) এই জমায়েতে হাজির নেই। এমনকি হুইল চেয়ারে চেপে মিসেস ক্রফটও হাজির হয়েছেন, আমার দিকে তাকিয়ে উনি মৃদু হাসলেন তাও এই সুযোগে আমার একটু বাড়ির বাইরে বের হওয়া হল।