আমার কোন ভুল হচ্ছে না মাদাম। ভুল হবার কোন সুযোগই নেই। পোয়ারো ঘুরে দাঁড়ায়। সিঁড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। আমি ওকে অনুসরণ করি।
আমাদের ঘরে এসে পোয়ারো ক্ষিপ্তভঙ্গিতে টুপিটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। পুরোপুরি অন্ধকারে রয়েছি। মাদাম জোয়েল নিকের মৃত্যুতে কে লাভবান হবে? মাদাম রাইস চকোলেট বাক্স কিনেছেন স্বীকার করছেন। তারপরেও উনি……… না, সেটা অত্যন্ত মূখের মত কাজ হবে। আর উনি মোটেই বোকা নন। একেবারেই না। সেক্ষেত্রে….।
কিন্তু উনি কোকেন নেন। হেস্টিংস ব্যাপারটা মাথায় রাখ। এতে কোন ভুল নেই। আর চকোলেটের ভেতর কোকেন পোরা ছিল তাতেও কোন ভুল নেই। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ? উনি বললেন অন্যটায়, এটায় নয়। এটার ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য চকোলেটের বাক্সটার কথাতো ওনার জানবারই কথা নয়। তাহলে? পোয়ারো একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে। ওর কপালে চিন্তার গভীর খাঁজ। মাদাম রাইস নিশ্চিতভাবেই কিছু জানেন। কিন্তু মুখ খুলছেন না। আর উনি সেরকম মহিলা নন কথার চাপে ঘাবড়ে গিয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু কি জানেন উনি? সেটা বলছেন না? ওনার টেলিফোনের কথা কি সত্যি? না উনি বানিয়ে বলছেন? যদি সত্যি হয় তাহলে ওটা কার গলার স্বর ছিল?
সব পুরো অন্ধকার।
হতাশার বহিঃপ্রকাশ শুনে আমি বললাম অন্ধকারের পরই কিন্তু সূর্যোদয় হয়।
পোয়ারো সমর্থনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, তাহলে, দ্বিতীয় আরেকটা বাক্স ছিল। সেটা এসেছিল ডাকযোগে।
আমি আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। পোয়ারো দ্রুত আমাকে বাধা দেয়, না, না, আবার একটা প্রবচন নয়। আমি আর নিতে পারব না। তুমি কি সত্যি আমার একজন শুভাকাঙ্খি বন্ধু?
আমি বেশ অবাক চোখে তাকাই অবশ্যই।
তাহলে যাও হেস্টিংস, এক বাক্স তাস কিনে আন।
আমি তীব্র চোখে ওর দিকে তাকালাম। আবার ঠাণ্ডা গলায় বললাম, বেশ।
আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম এই তাস কিনে আনবার অজুহাতে পোয়ারো এখনকার মতো ব্যাপারটা আমার কাছে এড়িয়ে যেতে চাইছে।
এখানেই আমি ওকে ভুল বুঝেছিলাম। সেই রাতে খাবার পর প্রায় ১০-১৫ মিনিট নাগাদ বসবার ঘরে এলাম দুজনে। দেখলাম আমার আনা তাসগুলো একটার ওপর একটা বসিয়ে সাজিয়ে ঘর বানাচ্ছে। আমি জানি এটা ওর পুরনো পদ্ধতি। যখন স্নায়ুর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়, পোয়ারো এইভাবেই স্নায়ুকে শান্ত করে, বলা ভাল নিজের স্নায়ুকে বশে আনে। এইসব দেখতে দেখতে চেয়ারে হেলান দিয়ে কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানি না। হঠাৎ পোয়ারোর ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভাঙল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, সোয়া পাঁচটা। সকাল হয়ে গেছে। চোখ কচলাতে কচলাতে পোয়ারোর দিকে তাকালাম, আমাকে দুহাত নাড়াতে নাড়াতে উচ্ছ্বাসভরা গলায় সে আমাকে বলে চলেছে, তুমি ঠিক বলেছ বন্ধু, একদম ঠিক বলেছিলে।
আমি আধো ঘুমের গলায় বলি–কি ব্যাপার?
মাদাম জোয়েল মারা গিয়েছেন।
কি-ই-ই-ই? আমি আঁতকে উঠি, চেয়ারে সটান উঠে বসি।
আরে না, না। সত্যি সত্যি ব্যাপারটা ঘটেনি।
আমি একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলি। উত্তেজনার চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাই। এ আবার কি ধরনের রসিকতা?
তবে ব্যাপারটার যদি ব্যবস্থা করা যায় আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে।
পোয়ারো হাশিখুশি ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকায়–খুনটা সম্পূর্ণ হল, চারবার, চারবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে খুনী সফল হল। আমি দেখতে চাই তারপর কি ঘটে?
খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হবে এটা। আমারও তাই মনে হচ্ছে না। আমার দিকে। তাকিয়ে কথাটা বললেও, আসলে নিজের মনে স্বগোতোক্তির মতো করে বলে।
.
১৮.
জানালায় একটি মুখ
পরের দিনের ঘটনাগুলো আমার স্মৃতিতে যথাযথ নেই। সকাল থেকেই প্রচণ্ড বেগে জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে প্রায় অচেতন হয়ে শুয়ে রইলাম। এরপর কি ঘটনা ঘটল কিছুই জানতে পারলাম না। শুধু শুয়ে শুয়ে জ্বরের ঘোরে বুঝতে পারছিলাম পোয়ারো একবার করে ঘরে আসছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে।
পরে জানতে পারলাম পোয়ারো ডাঃ গ্রাহামের সঙ্গে কথা বলে নিজের পরিকল্পনাটায় তাকে রাজি করায়।
ডাঃ গ্রাহামের বিশ্বস্ত কয়েকজন হাসপাতাল কর্মচারীকেও নিজের পরিকল্পনায় সামিল করে। অবশ্যই ডাঃ গ্রাহামের হাসপাতাল কর্মচারীদের প্রভাবেই এটা সম্ভব হয়। তারপর পুলিশ। কর্নেল ওয়েস্টন প্রথমে পোয়ারোর প্রস্তাবকে খুব একটা বাস্তবতার বা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মানতে পারছিলেন না। পোয়ারোর বোঝানোর পর তিনিও অনেকটা নিমরাজি হয়েই সম্মতি দিলেন। যদিও তিনি বেশ পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন ব্যাপারটাতে তার কোন দায়িত্ব থাকছে না। মিথ্যাচারের দায়িত্ব পুরোটাই পোয়ারোকে নিতে হবে। এবং তারপরের দায়িত্বও। পোয়ারো এককথায় রাজি হয়ে যায়।
সারাটা দিন কম্বল মুড়ে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম। মাঝে মাঝেই পোয়ারো এসে ঘটনার সাম্প্রতিকতম অগ্রগতি সম্পর্কে আমাকে ওয়াকিবহাল করে যাচ্ছিল। বিকেলের দিকে ঘরে এসে চোখ টিপে মুচকি হেসে বলল, এক প্রস্থ লিলি পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে বুঝলে? গভীর সমবেদনার সঙ্গে কথাটা বলে পোয়ারো।
একটু হেসে ও আবার যোগ করে কি ভয়ঙ্কর মজার ব্যাপার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও আবার বেরিয়ে যায়। রাতের দিকে আবার ঘরে আসে।একটু আগে মাদাম রাইসের সঙ্গে কথা হল। উনি প্রিয় বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুতে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। নিক নেই বিশ্বাসই করতে পারছেন না। বারবার বলছিলেন, ওরকম একজন ছটফটে, প্রাণচঞ্চল মেয়ে……… এ ভাবে অকালে……আমিও সর্বান্তকরণে ওর কথায় সায় দিলাম। ওহ কি মজার সব কাণ্ডটা যে ঘটবে এবার।