পোয়ারো সমর্থনের ভঙ্গিতে মৃদু বিনীত হাসে। তারপর বলে আর ডাঃ ম্যাক অ্যালিস্টার, ওনার ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেন?
আহ, নিশ্চয়ই। উনি মেয়েদের ডাক্তার। না, না গায়নোকলজিস্ট নয়, একজন হাতুড়ে ধরনের। সাধারণভাবে মহিলাদের যৌন ইচ্ছে সংক্রান্ত সমস্যার চিকিৎসাই করেন। সেসব ব্যাপারে ওনার চিকিৎসা নাকি খুবই ফলদায়ক।
এই ডাঃ ম্যাক অ্যালিস্টার কে? আমি বেশ অবাক ভাবে প্রশ্ন করি। আচমকা এই নামটা কোথা থেকে উড়ে এল?
ডাঃ ম্যাক অ্যালিস্টার হলেন কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গারের কাকা। মনে আছে উনি একবার উল্লেখ করেছিলেন, ওনার এক কাকা চিকিৎসক?
আমার মনে পড়ল, কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে তার যোগাযোগ কোথায়?
আমার প্রশ্নে পোয়ারোর কপালে ভাঁজ পড়ে, হয়ত কিছুই নেই। কিন্তু এরকুল পোয়ারো কোন গন্ধ না খুঁকে ছেড়ে দেয় না। হয়ত এইভাবেই খুলে যাবে কোন দরজা। আর হেস্টিংস দরজা যে সত্যিই খোলে, তার প্রমাণ তো অতীতে পেয়েছি আমরা। বহু……বহুবার। তাই না?
এরপর সন্ধ্যেটা বেশ ভালই কাটল। ইন্সপেক্টর জেপের অনুরোধে আমরা তিনজনেই কয়েক পাত্র পোর্ট পান করলাম। পোয়ারো এবং জেপ পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনে ডুবে গেল। বেশ লাগছিল শুনতে। কিন্তু কখন যেন আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, মন ডুবে গিয়েছিল বর্তমান মামলার ঘটনায়। পোয়ারো এখনও যেভাবে কোন তথ্য বা সূত্র খুঁজে পায়নি। অথচ মামলাটা হাতে নেবার পর দিন কম গেল না। আমার কেমন শীত শীত করে উঠল হঠাৎ তাহলে….. তাহলে কি এরকুল পোয়ারোকে প্রথমবার পরাজয় স্বীকার করে নিতে হবে? পোয়ারোর চোখের সামনে ম্যাগি বার্কলির মৃত্যুটা কি তাহলে সেই অনিবার্যতার নিষ্ঠুর ইঙ্গিত? হঠাৎ পিঠে হাতের চাপে আমার ঘোর কাটল। সম্বিত ফিরে পেলাম। পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি ভাবছ বন্ধু?
নাহ, কিছু না, কিছু না। নিজের অপ্রস্তুত ভাবটাকে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে বলে উঠি।
সাহস রাখ, প্রিয় বন্ধু সাহস রাখ। পোয়ারো আমার পিঠে হালকা চাপড় মারে, সব কিছু এখনও শেষ হয়ে যায় নি।
আমি হেসে উঠি। পোয়ারো আমার মনের অবস্থাটা নির্ভুল বুঝতে পেরেছে। আমার। হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পোয়ারোও হাসে। আমাদের হাসতে দেখে ইন্সপেক্টর জেপও সশব্দে হেসে ওঠেন।
এরপর আমরা হাসিখুশি মনে বিদায় নিই ইন্সপেক্টর জেপের কাছ থেকে। পরের সকালে আমরা আবার সেন্ট লু ফিরে আসি। হোটেলে পৌঁছে পোয়ারো নার্সিংহোমে ফোন করে এবং নিকের সঙ্গে কথা বলতে চায়। হঠাৎ করেই আমি ওর মুখের ভাব বদলে যেতে দেখি। প্রবল হতাশা, চিন্তা, উদ্বেগ ফুটে ওঠে যুগপৎ ওর মুখে। হা, হা, আমি এখনি আসছি। ফোনটা ছেড়ে দিয়ে পোয়ারো প্রবল রাগ মেশা হতাশায় মাথা ঝাঁকায়, কি কান্ড। চল হেস্টিংস। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে এক চরম আশঙ্কা ভেসে ওঠে। আতঙ্কিত গলায় আমি বলি কি হয়েছে পোয়ারো?
মাদাম জোয়েল নিক ভয়ঙ্কর অসুস্থ। কোকেন বিষক্রিয়াতে আক্রান্ত। Mon Dieu, Mon Dieu, কেন যে আমি ওনাকে এখানে রেখে চলে গিয়েছিলাম? কেন?
.
১৭.
এক বাক্স চকোলেট
নার্সিংহোমে যাবার পুরো রাস্তাটা পোয়ারো নিজের মনে বিড়বিড় করে চলল। নিজের অতি আত্মবিশ্বাসকে অভিশাপ দিচ্ছিল। আমার বোঝা উচিত ছিল। স্বগতোক্তি করে পোয়ারো বলে ওঠে আমার বোঝা উচিত ছিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে রুষ্ট গলায় বলে, কিন্তু আমি থাকলেই বা কি হত? আমি যা ব্যবস্থা করেছিলাম মাদাম নিকের কাছে পৌঁছন অসম্ভব। হ্যাঁ, পুরোপুরি অসম্ভব। কেউ নিশ্চয়ই আমার নির্দেশ অমান্য করেছে–কে?
আমরা নার্সিংহোমে পৌঁছবার পর একতলায় একটা ছোট্ট ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ডাঃ গ্রাহাম একটু পরই এলেন। তাকে রীতিমত বিধ্বস্ত, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। চিন্তা করবেন না। উনি ঠিক আছেন। সমস্যাটা হচ্ছিল উনি কতটা বিষ শরীরে নিয়েছেন বুঝতে না পারায়। এখন পরিস্থিতি সামলে নেওয়া গেছে।
কিন্তু কি ভাবে এটা ঘটল? পোয়ারো ডাক্তারের কথা শুনে প্রথমে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, এরপর তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্নটা করে। ভেতরে যেতে কাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল?
না না কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হয়নি।
অসম্ভব পোয়ারো দৃঢ় গলায় বলে।
না না, আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন।
কিন্তু, তাহলে………… পোয়ারোর গলায় তীব্র সংশয় ভেসে ওঠে।
এক বাক্স চকোলেট।
ওহ-হ। আমি ওনাকে বলেছিলাম, হে ভগবান, বার বার বুঝিয়েছিলাম বাইরে থেকে আসা কিছু খাওয়া তো দূরের কথা, স্পর্শও না করতে।
আমি সেটা জানতাম না। বোঝেনই তো কোন মেয়েকে চকোলেট থেকে দুরে রাখা কত কঠিন। তবে ভগবানকে অজস্র ধন্যবাদ, উনি মাত্র একটাই খেয়েছিলেন।
চকোলেটের ভেতর কি ভাবে কোকেন পোরা হয়েছে?
খুব শক্ত কাজ মশায়। মাঝখান থেকে অর্ধেক করে ভেতরটা বার করে দিয়ে কোকেন পুরে দিয়ে আবার চকোলেটটা জোড়া দেওয়া হয়েছে। একেবারে অপেশাদার কাঁচা হাতের কাজ।
পোয়ারো মৃদু একটা খড়খড় শব্দ করে।
আমি ক্ৰমে ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। যাই হোক, একবার কি মাদাম জোয়েলের সঙ্গে দেখা করা যাবে?
আমার মনে হয় ঘণ্টাখানেক পর যদি আপনি আসেন তবে ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।
আমরা ঘণ্টাখানেক সেন্ট লু-র রাস্তায় অলসভাবে হেঁটে বেড়ালাম। পোয়ারো এক মনে কি যেন চিন্তা করে চলেছে হাঁটতে হাঁটতে। আমি কথা বলে ওর মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটালাম না। মাঝে মাঝেই পোয়ারো মাথা নাড়ছিল আমার ভয় করছে হেস্টিংস। ভয় করছে। বেশ ভয় করছে। এমন অদ্ভুত, শরীর শিরশির করে ওঠা ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিল যে আমিও রীতিমত আতঙ্কিত বোধ করতে শুরু করলাম। একসময় ও হঠাৎ আমার কবজির কাছটা খামচে ধরল, আমি ভুল করেছি। শোন বন্ধু, আমি প্রথম থেকেই ভুল করছি।