হ্যাঁ হেস্টিংস, এই টুপিটা।
সে টুপিটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়–দেখ তো কেন আমি টুপিটার প্রতি এত বিশেষভাবে উৎসাহি বুঝতে পারো কি না।
সুন্দর টুপি! আমি টুপিটা হাতে নেবার আগ্রহ পর্যন্ত দেখাই না।
তবে, খুবই সাধারণ না বলে থাকতে পারি না। বহু মেয়েই এই ধরনের টুপি ব্যবহার করে। শেষ মন্তব্য করার মত করে বলি।
নাহ, এটার মত মোটেই নয়। আমি তীব্র চোখে আবার তাকাই।
দেখতে পাচ্ছো?
–এটা একটা সুন্দর টুপি ঠিকই। সুন্দর স্টাইল। অথচ খুবই সাধারণ।
ওহঃ হেস্টিংস, প্রিয় হেস্টিংস কেন বলত–আমি যা দেখতে পাই তুমি তা দেখতে পাও না? পোয়ারো টুপিটাকে হাতের আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে ঘোরাতে থাকে। সেটা বনবন করে ঘুরতে থাকে।
সবসময় যে মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলোকেই গাৈয়েন্দাগিরির জন্য ব্যবহার করতে হবে, তা নয় হেস্টিংস। চোখ…… কখনও কখনও চোখকেও তীক্ষ্ণভাবে চতুরতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়।
কথা শেষ হয় না পোয়ারোর, এবার আমার নজরে পড়ে টুপিটার শীর্ষভাগে নিখুঁত গোল একটা ফুটো। সামান্য একটা ফুটো
চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে যায়। আমি প্রায় হতবাক, স্তব্ধ চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাই। বন্ধুবরের মুখে সম্মতিসূচক মৃদু হাসি। মাথা নেড়ে সায় দেবার ভঙ্গিতে সে বলে-তুমি ঠিকই ভেবেছ হেস্টিংস, ঠিক তাই। বুলেট।
বুলেট?
আমার গলায় অদ্ভুত লাগে কথাটা। মানে তুমি বলতে চাও……..
আমি বলতে চাই এক ইঞ্চির তফাতে হলেই বুলেটটা টুপি নয় মাথা গর্ত করে দিত।
একটু থেমে তির্যক হেসে আমার দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বলে-এখন কি বুঝতে পারছ প্রিয় বন্ধু, কেন আমি এত ইন্টারেস্টেড?
একটু থেমে সে আবার বলে–অবশ্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কারণ তুমিই তো বলেছিলে অসম্ভব বলে কিছুই নেই, হয় না তাই না?
.
০২.
এন্ড হাউস
পোয়ারো, আমি ভাবছি খুবই আদরনীয় অভ্যাস, প্রশংসনীয়ও, চালিয়ে যাও। জানালার পাশে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসেছিলাম। দুপুরের খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। গুলিটা খুব কাছ থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। অথচ আমরা কেউ তা শুনতে পেলাম না।
না হেস্টিংস-সোঁ সোঁ তীব্র হাওয়া, উতাল সমুদ্রের ঢেউ-এর গর্জন তার মধ্যে তা সম্ভবই নয়। একেবারেই নয়।
একটু ভেবে নিয়েই পোয়ারো আবার বলে-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের মাদাম জোয়েলের সঙ্গে একবার দেখা করতেই হবে। তিন দিনের মধ্যে তিনটে মৃত্যুর হাতছানি এড়িয়ে যাওয়া, না–ব্যাপারটা…….
আমরা এরপর নীরবে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আচমকা জানালার বাইরে তাকিয়ে পোয়ারো খুশির গলায় বলে ওঠে–ওহ কি চমৎকার সংযোগ।
আমি তাকালাম। সদলবলে মাদাম জোয়েল বার্কলি এই বেঁস্তোরার দিকেই আসছেন।
পোয়ারো দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় এবং সহাস্যে অভিবাদন জানিয়ে টুপিটা মিস বার্কলির দিকে এগিয়ে দেয়।
মেয়েটি হেসে টুপিটা গ্রহণ করে। ওরা এসে টেবিলে বসে।
ওদের দলটা ছিল চার জনের–মিস বার্কলি, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার, একজন যুবক এবং একজন যুবতী।
আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে ওদের দলটাকে লক্ষ্য করাটা বেশ অসুবিধাজনক ব্যাপার। তারই মধ্যে বারবার আড়চোখে দেখছিলাম আর আড়ি পাতছিলাম। নৌ অফিসারটির উচ্চস্বরে হাসির শব্দ ভেসে আসছিল বারবার। আপাতদৃষ্টিতে মানুষটি আমুদে, প্রাণখোলা এবং সরল প্রকৃতির বলে মনে হয়।
বন্ধুবরকে বেশ কিছুটা মনোযোগাচ্ছিন্ন দেখাচ্ছিল। খাওয়ার প্রতি তার যেন কোনও মনোযোগই ছিল না। নীরবে এলোমেলো ভঙ্গিতে টুকটুক করে খেয়ে চলেছে। আমি বারকয়েক কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ওর কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে চুপ করে গেলাম। খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরও পোয়ারো টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে লাগল কখন ওদের মুখোমুখি হবে।
ভাবতে ভাবতে ওরা খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে লাউঞ্জের দিকে এগোচ্ছে।
পোয়ারো ঝটপট টেবিল থেকে উঠে পড়ল।
ওরা সবে গিয়ে লাউঞ্জে দাঁড়িয়েছে, পিছন থেকে পোয়ারো ডাকল–মাদাম, আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা ছিল।
মেয়েটি পিছন ফিরে তাকাল। ওর চোখে চাপা অস্বস্তি।
আমি ওর মনের অবস্থাটা তখন পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। রোগা চেহারার এই বিদেশিনীর খোঁজখবর না জানি কি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করবে কে জানে।
মাদাম কয়েক পা সরে দাঁড়ায়। পোয়ারো তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলে।
কয়েকমুহূর্ত পরই আমি ওর চোখে মুখে পরম বিস্ময় ভেসে উঠতে দেখি।
আমি এই পরিস্থিতিতে যথার্থ অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার আমার উদ্ধারে এগিয়ে এলেন। একটা সিগারেট এগিয়ে এলেন। একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে এলোমেলো কথা জুড়ে দিলেন। আমি কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে ছিলাম যে আমি মোটেই আমার কৌতূহলপ্রবণ সঙ্গীটির মত নই। আর সেই ফাঁকে আমি আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গেলাম। লম্বা, পাতলা, ফর্সা সপ্রতিভও এক যুবক। কিছুটা মাংসল নাক। নিজের সম্বন্ধে একটা উন্মাসিকতা রয়েছে। সেটা আমার খুব একটা পছন্দ হচ্ছিল না। তারপর আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। ওর মধ্যে একটা অসাধারণত্ব রয়েছে। চূড়ান্ত অসাধারণ এক প্রতিচ্ছবি, ম্যাডোনার মত-ফর্সা রঙ, ধারালো চেহারা। প্রায় রঙহীন চুল। বড় বড় চোখের তারা। ধূসর তার রঙ। যুবকটি আমার দিকে তাকায়।