মেয়েটি কেমন যেন নিস্পৃহ গলায় বলে।
সেরকমভাবে বলার মত কিছু নয়। তবে আমাদের বার্কলি পরিবারের গ্রাম তিনশো বছরের পুরানো! আমার ভাই চারবছর আগে মারা গেছে, সে অর্থে বলতে গেলে আমিই এই পরিবারের শেষতম সদস্য।
ওহ, খুবই দুঃখের ঘটনা। ওই বাড়িতে আপনি একাই থাকেন মাদাম জোয়েল?
বেশির ভাগ সময়ই আমি বাইরে থাকি। তবে যখন এখানে এসে বাস করি, পরিবারের নানান আত্মীয়-স্বজন আসেন–আমার সঙ্গে থাকেন, যাতায়াত করেন।
পোয়ারো শব্দ করে হেসে ওঠে, আর আমি নিজের কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম অন্ধকার, পুরানো ওই রহস্যময়, ভুতুড়ে বাড়িতে আপনি একা থাকেন আর আপনাকে তাড়া করে বেড়ায় এক বহু পুরানো পারিবারিক অভিশাপ।
যুবতীটি যেন চমকে ওঠে, কি আশ্চর্য, আমাকে বলতেই হবে আপনার মধ্যে অনুমান করার, ছবির মত ভেবে নেবার অসাধারণ এক ক্ষমতা রয়েছে।
না, ওটা ভুতুড়ে বাড়ি নয়। আর তা যদি হয়ও, তারা খুবই উপকারী ভূত। আমি অন্তত তিনবার আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি।
পোয়ারো আচমকা উঠে দাঁড়ায়, মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন? হুম, বেশ উত্তেজক কাহিনী বলে মনে হচ্ছে।
না, না, সেরকম চমকপ্রদ কোনও ব্যাপার নয়। নিছক দুর্ঘটনা বলেই আমার বিশ্বাস।
ইতিমধ্যে আমাদের জন্য পানীয় এসে পৌঁছাল। আমরা যে যার গ্লাস তুলে নিলাম।
এই হোটেলের ককটেল সত্যি উপাদেয়। পোয়ারো গ্লাসে একটা চুমুক দেয়, সে কথা মেনে নিতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমরা আবার নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে থাকি ককটেল চুমুকসহ।
আমরা যে বাইরের ঝুল বারান্দায় বসেছিলাম তার ঠিক নিচেই গাঢ় সবুজ ঘাসের রাস্তাটা ক্রমশ ঢাল হয়ে নেমে গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। আর এই মুহূর্তে সেই ঢাল বেয়ে উঠে আসছে একজন পুরুষ। লাল মুখ, একজন টিপিক্যাল নাবিকের চেহারা।
ওহ্ কোথায় যে গেল মেয়েটা। তার তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল, ভেসে এল সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে। …
নিক, নিক। আবার তার গলা ভেসে এল।
মিস বার্কলি উঠে দাঁড়ালেন, এই যে জর্জ, আমি এখানে।
আহ, তুমি ওখানে কি করছ মেয়ে?
ফ্রেডি পানীয়ের জন্য ক্ষেপে উঠেছে একেবারে চলে এস, চলে এস। তাড়াতাড়ি।
নিচের থেকে পোয়ারোর দিকে সন্দিহান চোখে তাকাল জর্জ।
স্বাভাবিক! নিকের অন্যসব বন্ধুদের তুলনায় পোয়ারো নিঃসন্দেহে চেহারা, গরিত্রে একেবারে ভিন্নতর। ..
যুবতীটি ততক্ষণে আলাপ করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে–ইনি হলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কমান্ডার শ্যালিঙ্গার।
আমি থতমত হয়ে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকাই। কিন্তু সে নির্বিকার মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে জর্জকে অভিবাদন জানায়।
মেয়েটি এবার বন্ধুর পরিচয়ের জন্যে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পোয়ারোর সঙ্গে পরিচয় দেবার কোন আগ্রহ বা উৎসাহ দেখা যায় না!
বাধ্য হয়ে নিক বলে–আজ তাহলে চলি। ককটেলের জন্য ধন্যবাদ। আশাকরি আপনার পা খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। ধীর পায়ে সে চলে যায় একসময় শ্যালিঙ্গার আরমিকের চেহারা দুরে সরে যেতে যেতে মিলিয়ে যায়।
সুতরাং, এই তাহলে মাদাম জোয়েলের সঙ্গে এন্ড হাউসের বসূবাসকারী বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের একজন। চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে কিড়বিড় করে পোয়ারো।
তোমার কি মনে হয় হেস্টিংস? তোমাকে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে হলে তুমি কি বলবে? মানুষটি ভাল?
মানুষটি ভাল? এই কথাটির দ্বারা পোয়ারো ঠিক কি বোঝাতে চায়?
আমি ওর চিন্তার খেই ধরতে পারি না। তবে, একঝলকঃচিন্তকরে বলি–হ্যাঁ, আমার তো মনে হয় ভালই। অবশ্যই ওপর ওপর দেখে যতটা বোঝা যায়।
আর তখনই পোয়ারোর নজরে পড়ে তাড়াহুড়োয় নিক তার টুপিটা ফেলে রেখে গেছে।
পোয়ারো টুপিটা তুলে নিয়ে তাতে আঙ্গুল বুলোতে থাকে। গভীর চিন্তাক্লিষ্ট দেখায় তাকে।
লোকটার কি নিকের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে?
সেটা আমি কি করে বলতে পারি পোয়ারো?
কথাটা বলেই আমি হাত বাড়াই, দাও, টুপিটা আমাকে নও; মিঙ্গ বার্কলির হয় এটা দরকার হতে পারে। আমি দিয়ে আসি।
নিশ্চয়ই। গভীর চিন্তায় ডুবে থাকা অন্যমনস্ক জায়গায় পোয়ারো বলো টুপিটা একইভাবে আঙ্গুল বুলিয়ে চলে। টুপিটা ফেরত দিতে এন্ড হাউসে তুমি একা যাবে না মেটেই। আমরা দুজনে যাব। একটু থেমে আবার অদ্ভুত গলায়রুলেআবার ওই সুন্দরী, চার্মিং মহিলাটিকে দেখবার জন্যে আমি উদগ্রীব হয়ে উঠেছি এরই মধ্যে।
আমি কটাক্ষ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার গলায় কুলি-ওই বুড়ো বয়সে শেষপর্যন্ত প্রেমে পড়লে নাকি হে?
মেয়েটি সুন্দরী। তাই নয় কি?
কারণ, হেস্টিংস তার নিজের বোধ, বিচার-বুদ্ধির ওপর আর তেমন কোনও আস্থা নেই। মেয়েটি বিপরীত লিঙ্গের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় বলে তোমার মনে হয় না কি? : আমি কিছুটা বিরক্ত-ভঙ্গিতে বলি–উত্তরটা নিঃসন্দেহে সদর্থক। কিন্তু পোয়ারো, আমি কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না মহিলার প্রতি তুমি এতটা ইন্টারেস্ট কেন দেখাচ্ছ?
আমি মহিলার প্রতি ইন্টারেস্টেড?
তোমার কথাবার্তা কি সেটাই প্রমাণ করছে না? পোয়ারো টুপিটাকে তার চোখের সামনে তুলে ধরে গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
সত্যি কথা বলতে কি বন্ধু হেস্টিংস, মেয়েটির থেকেও আমি ওর টুপিটার প্রতি বেশি উৎসাহি। আমি আবার মোয়রোর দিকে তাকাই। কিন্তু ওর মুখ চোখ যথেষ্ট সিরিয়াস।