আমার বিস্ময় উত্তোরোত্তর বেড়ে চলে–শীত? এমন চমৎকার রাতে তোমার শীত লাগছে?
চমৎকার রাত? পোয়ারো গোঁফে হাত বুলোত বুলোতে বলে–হ্যাঁ, তা তুমি বলতে পারও বটে। যতক্ষণ না তোমার চাঁদিতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, তুমি কি বুঝতে পারও যে সত্যি বৃষ্টি পড়ছে? এখানেও যদি একটা থার্মোমিটার থাকত তুমি বুঝতে পারতে আমি কতটা সত্যি বলছি।
আমি প্রখর চোখে এবার পোয়ারোর দিকে তাকাই। তোমার মতলবটা কি বলত? আসল কথাটা এবার বল দেখি।
পোয়ারো এবার পরম মমতায় আমার কাঁধে হাত রাখে। প্রিয় বন্ধুবর, আমি বলতে চাইছি তুমি একটা গ্রীষ্মপ্রধান দেশ থেকে এসেছ। এদেশের শীত নিয়ে তোমার এভাবে ছেলেখেলা করা উচিত নয়।
আমি এবার মুচকি হেসে (কম দিন ওর সঙ্গে তো নেই। ওর ইশারা কোন দিকে চলেছে বুঝতে এখন আর দেরি হয় না, অসুবিধা হয় না) বলি–ঠিক আছে। আমার মত পা তুলে হাঁটতে হাঁটতে (মাটির ভিজে ভাব থেকে পা বাঁচানোর নাটক) আসতে থাকে সে।
আমরা বাড়ির একশো গজের মধ্যে চলে এসেছিলাম। বুঝলে হেস্টিংস, আমাদের সবারই হৃদয়ের মধ্যে একটা শিশু লুকিয়ে আছে।
আমি আচমকা পোয়ারোর হাতটাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। পোয়ারোর হাত আঁকড়ে ধরে মৃদু টান মারলাম। পোয়ারো মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি আঙুল দেখালাম। আমার অঙ্গুলি নির্দেশ লক্ষ্য করে পোয়ারো তাকায় সেদিকে। আমাদের সামনেই….. আমাদের আর ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটার মাঝখানে…… আবছা একটা শরীর। কালো চীনা শাল জড়ান।
মন দেউই ডাই, স্পেনিশ ভাষায় পোয়ারো ফিস ফিস করে বলে ওঠে–হে ভগবান।
.
০৮.
ভয়ঙ্কর শাল
বোধহয় খুব বেশি হলে ৪০ সেকেন্ডের মত থমকে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। আতঙ্কহত। স্থানুবৎ। কিন্তু আমাদের কাছে সেটুকু সময়ই যেন দীর্ঘ এক যুগ মনে হল। তারপর, প্রায় যন্ত্রচালিতের মত পোয়ারো সেদিকে এগিয়ে গেল। শেষপর্যন্ত, ব্যাপারটা ঘটল।
পোয়ারো বলল, ওর স্বরে ঝরে পড়া রাগমেশানো তিক্ত হতাশার পরিমাপ করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
আহ-হ, সবকিছু সত্ত্বেও, আমার সবরকম সতর্কতা সত্ত্বেও, ব্যাপারটা ঘটলই, সখেদে বলে পোয়ারো।
আমি একজন উৎকৃষ্ট অপরাধী। আমি কেন ওকে আরও ভাল ভাবে পাহারা দিলাম না? আমার এক মুহূর্তের জন্যেও ওর পাশ থেকে সরে যাওয়া উচিত হয়নি।
তোমার নিজেকে এভাবে দোষী ভাববার কারণ নেই। আমি বলতে চাইলাম। কিন্তু আমার জিভে মুখের ওপরের অংশে আটকে গেল। শুকনো জিভ, গলা দিয়ে একরাশ ঘড়ঘড়ে শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হল না।
পোয়ারো প্রত্যুত্তরে সখেদে, প্রবল তিক্ততাময় দুঃখিত ভঙ্গিতে আরও একবার সজোরে মাথা নাড়ল।
মৃতদেহের পাশে বসে পড়ে সে। আর তখনি আমাদের মধ্যে দ্বিতীয় ঝটকাটা এসে হাজির হল। বাড়ির ভেতর থেকে নিক বার্কলির গলা ভেসে এল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ঘরের আলোকিত দরজায় আবছা ছায়া দেখা গেল।
ওহ, দুঃখিত ম্যাগি, আমি বোধহয় একটু বেশি সময় নিয়ে ফেললাম। দ্রুতপায় এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় নিক। তীব্র চোখে পরিস্থিতি নজর করে। তীক্ষ্ণ এক বিস্ময়ের অভিঘাতে পোয়ারো দ্রুত হাতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মৃত দেহটাকে দু’হাতে চিৎ করে শুইয়ে দেয়।
নিক ততক্ষণে আমাদের পাশে চলে এসেছে। নিমেষে চেরা গলায় আতঙ্ক ও শোকমহিত তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে নিক–ম্যাগি, হে ভগবান….. ম্যাগি, না এ হতে পারে না…….. পোয়ারো তখনও মেয়েটিকে পরীক্ষা করছিল হাঁটু মুড়ে বসে।
ও….. ও কি…..?–নিকের গলা ভেঙ্গে যায়
পোয়ারো দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা হেলায়–হ্যাঁ মাদাম জোয়েল, উনি মারা গিয়েছেন।
কিন্তু কেন? ম্যাগিকে কেন কেউ খুন করবে?
পোয়ারো চটজলদি উত্তর দেয়, দৃঢ় গলায় বলে–ওনাকে খুন করাটা উদ্দেশ্য ছিল না মাদাম জোয়েল। খুনীর লক্ষ্য ছিলেন আপনি, হ্যাঁ, আপনি ওই কালো শালটাই প্রধান লক্ষ্য নিশানা ছিল খুনীর। ভুলের কারণ ওই কালো শালটাই।
একটা তীব্রতর, বুক ফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নিক–কেন, কেন আমার সঙ্গে এটা ঘটল না। তীক্ষ্ণ কান্নামাখা গলায় চিৎকার করে ওঠে সে–আমার সঙ্গে কেন এটা ঘটল না? হে ভগবান, আমি আর বাঁচতে চাই না। এখন, আমি মরতে পারলে খুশি হতাম।
পোয়ারো সান্ত্বনার ভঙ্গিতে নিকের কাঁধে হাত রাখে–মাদাম জোয়েল, শান্ত হন।
হেস্টিংস, তুমি পুলিসকে একটা ফোন করে দিও।
আমি নিকের হাত ধরে দাঁড় করাই। ওকে যখন বাড়ির ভিতর নিয়ে যাচ্ছি পোয়ারো তখন আমাকে প্রায় আদেশের সুরে বলে–সবসময় মাদাম জোয়েলের সঙ্গে থাকবে। হেস্টিংস, মনে রেখো, এক মুহূর্তের জন্যেও ওকে চোখের বাইরে যেতে দেবে না, ওর পাশ থেকে নড়বে না।
আমি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিই। প্রায় অচেতন নিককে ঘরে এনে একটা সোফায় শুইয়ে দিলাম। মাথার নিচে একটা কুশন দিয়ে দিলাম। তারপর একটা টেলিফোনের খোঁজ করতে লাগলাম। ঠিক তখনই এলিন ঘরে ঢুকল প্রায় ছুটতে ছুটতে। আর একটু হলে আমার সাথে ওর ধাক্কা লাগছিল। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। আমি লক্ষ্য করি, ওর চোখে-মুখে আশ্চর্য রকমের একটা অভিব্যক্তির ছাপ। দু’চোখ যেন জ্বল জ্বল করছে কিছুর প্রত্যাশায়! বারবার দুই শুকনো ঠোঁটের ওপর সে জিভ বোলাচ্ছিল। ওর দু’হাত কাঁপছিল থরথর করে। মনে হচ্ছে সে যেন কোনও উত্তেজনা বা উদ্বেগে ভুগছে।