জর্জ এখনও এল না। চিন্তিত স্বরে কথাগুলো বলে আমাদের দিকে তাকায়–কাল রাতে ও প্লাইমাউথ গেছে। আজ সন্ধ্যাতে ফিরে আসবার কথা। যে কোনও সময় সে চলে আসবে। নাচ শুরু হবার আগেই সে এসে পড়বে আশা করা যায়।
ঠিক সেসময় জানালার বাইরে একটা টানা, তীক্ষ্ণ গর্জন শোনা গেল। টানা, চাপা গর্জন।
ওহ এই স্পিডবোটগুলো……. জ্বালিয়ে মারল– লাজারুম বিরক্তির গলায় বলে।
ওগুলো স্পিডবোটের শব্দ নয়। সি প্লেন-নিক ওর স্বভাবোচিত শান্ত গলায় বলে।
হ্যাঁ, আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ– লাজারুম জবাব দেয়।
কথার প্রসঙ্গ এবার ধীরে ধীরে ক্রমে সেই দিকে ঘুরে যায়। কথা প্রসঙ্গেই লাজারুম একসময় বলে–মাইকেল স্যাটন যদি তার বিশ্ব পরিক্রমায় সফল হন, তাহলে সত্যি সেটা আমাদের দেশের পক্ষে ও স্যাটনের জন্যে তো অবশ্যই গৌরবজনক ঘটনা হবে। খুবই দুঃখের ব্যাপার যে ওনার সঙ্গে কি কি ঘটেছে তাই এখনও পর্যন্ত জানা গেল না।
আমার মনে হয় উনি এখনও ভাল আছেন, ঠিক আছেন। নিকের কথার জবাবে লাজারুম অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ভগবান যেন তাই করেন। তোমার কথাই যেন সত্যি হয়।
সবাই ওনাকে পাগল স্যাটন বলে, তাই না?–এবার ফ্রেডরিকা রাইস বলে।
হ্যাঁ, ওদের বংশটাই একটু পাগলাটে। ওর এক কাকা গত সপ্তাহে মারা গেলেন। তিনি কোটিপতি ছিলেন। একটা বার্ড স্যাংচুয়ারি চালাতেন। তারও পাগলাটে বলে দুর্নাম ছিল।
লাজারুমের কথার প্রত্যুত্তরে ফ্রেডরিকা বলে–নারীবিদ্বেষী হিসাবেও উনি যথেষ্ট কুখ্যাত ছিলেন। আমার মনে হয়, তোমরা মিথ্যে ভয় পাচ্ছ, মাইকেল স্যাটন মোটেই মারা যাননি। ওনার কিছু হয়নি।
নিক এবার যেন কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাটা বলে।
তোমার সাথে ওনার পরিচয় ছিল। তাই না?–লাজারুম প্রশ্ন করে।
গত বছর আমার আর ফেড্রির সঙ্গে লা টকিউটয়ে ওনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। চমৎকার মানুষ উনি। তাই না ফ্রেডি?।
নিকের প্রশ্নে মিসেস রাইস কটাক্ষ হানলেন, আমাকে জিজ্ঞাসা কর না প্রিয়তমা। ওনার আগ্রহ তোমার বিষয়েই শুধুমাত্র ছিল। উনি তত একবার তোমাকে বাইরেও নিয়ে গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, স্কারবরো। অসাধারণ অভিজ্ঞতা-কথা শেষ করে, সবার থেকে অনুমতি নিয়ে নিক উঠে দাঁড়াল নাহ, আর দেরি করার মানে হয় না। আমি ফোনটা করেই আসি। দেখি জর্জের আসতে আর কত দেরি হবে।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। ন’টা বেজে গেছে। ভেজাট এবং রাম দেওয়া হয়েছে যার যার পছন্দ মত। পোয়ারো লাজারুমের সঙ্গে শিল্প বিষয়ে কথাবার্তা বলতে লাগল। ফ্রেডরিকা রাইস দু’হাতের ওপর থুতনি ভর দিয়ে নিঃশব্দে, স্বাস্নালু ভঙ্গিতে বসে রইলেন। আমি ম্যাগি বার্কলির সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্পগুজব করতে লাগলাম। এভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকমিনিট। নটা বেজে কুড়ি মিনিট নাগাদ দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে নিক বার্কলি।
সবাই এবার বাইরে এস।
সবাই বাধ্য অনুগতভাবে উঠে দাঁড়াই। ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন অতিথি এসে হাজির হয়েছেন। সব মিলিয়ে বারো জনের মত। নিক খুবই ভাল গৃহকর্ত্রী দেখা গেল। সবাইকে একই রকম উষ্ণতার সঙ্গে স্বাগত জানাল। অতিথিরা প্রায় কেউই তেমন আগ্রহী হবার মত নয়। তবে অতিথিরা একজন ছিলেন চার্লস ভ্যাইস।
আমরা সবাই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দূরে সমুদ্র ও বন্দর আবছাভাবে দেখা যাচ্ছিল। উপভোগ্য-এর মনোরম দৃশ্য। যেন একটা হীরের নেকলেশ, মনে হচ্ছে দূর থেকে বিদ্যুতের আলোয় সজ্জিত সেই জায়গাটাকে। বয়স্কদের জন্যে বাগানে কয়েকটা চেয়ারও পাতা রয়েছে। এবার বাজি পোড়ানো শুরু হল। প্রথমটা একটা রঙিন হাউস। নানা রঙের আগুনের তারা ছড়াতে ছড়াতে আকাশমুখী হয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় সে বিস্ফোরিত হল।
রাতটা ছিল ঘন অন্ধকারে ঘেরা। নতুন চাঁদ দেখা দিতে আরও তিন দিন বাকি এবং এক আপাদমস্তক গ্রীষ্মরাতের আদর্শ উদাহরণ আজকের রাতটা। খুবই শীতলতম রাত। সমুদ্রের ঝড়ো হিমেল হাওয়ায় আমার পাশে দাঁড়ানো ম্যাগি বার্কলি কঁপছিল। একটা কোট গায়ে চড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। এই সময় ফ্রেডরিকাও বলে উঠলেন–ম্যাগি, আমার ঘর থেকে আমার একটা কোট নিয়ে এস না।
ও শুনতে পাবে না। দাঁড়াও, আমি এনে দিচ্ছি।
নিক বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আমার নিজের জন্যও দরকার গরম জামার। এই শালে এত ঠান্ডা মানছে না–হালকা গলায় বলে সে। ঠিক সেই মুহূর্তে তীক্ষ্ণ শিষ দিয়ে সমুদ্রের বুক থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠে এল। বাজি পুড়েই চলেছে। চোখ ভরিয়ে দেবার মত দৃশ্য। দেখতে দেখতে আমি আমার পাশেই দাঁড়ানো এক বয়ষ্ক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে গল্প শুরু করে দিয়েছিলাম।
বুম বুম বুম আকাশে একের পর এক বাজি বিস্ফোরিত হয়েই চলেছে এবং তারপর কোনটা সোনালি রাশি হয়ে ঝরে পড়ছে, কোনটা থেকে নীল হাউস আরও উপরের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আবার কোনটা সবুজ বলের সারি হয়ে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম এসব।
পোয়ারো এতক্ষণ কোথায় যেন উঠে গিয়েছিল। এবার আবির্ভাব ঘটল তার। আমার কানের কাছে মুখটা এনে বলল–বড্ড, একঘেঁয়ে ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত। আমি সবিস্ময়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। পায়ের তলায় মাটিটা পর্যন্ত সাতাত করছে। শীতে পা’দুটো অবশ হয়ে যাচ্ছে।