হুম। পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলে–আমাদের কথপোকথনের মধ্যে তোমার ওনার কোন বিষয় অস্বাভাবিক বা মিথ্যাচার বলে মনে হয় নি? পোয়ারো আবার প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, অবশ্যই। এন্ড হাউস বিক্রির ব্যাপারটা।
একেবারে ঠিক ধরেছ। পোয়ারো সমর্থনের গলায় বলে–তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে-মাদাম জোয়েল বার্কলি-র এন্ড হাউসের ব্যাপারে মনোভাবটা তোমার ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর নিবেদিতপ্রাণ বলে মনে হয়েছে?
না, কখনওই ওনাকে এ বিষয়ে অতখানি অনড় মনে হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীমান ভাইটি এভাবে বাড়িয়ে ব্যাপারটাকে বলছেন কেন? এর সহজ ব্যাখ্যা-ব্যাপারটা নিয়ে এদের দু’জনের কেউ একজন মিথ্যা বলছেন। এখন আমাদের যথাসম্ভব দ্রুত জানতে, খুঁজে বের করতে হবে সেটা কে? এবং কেন?
পোয়ারো আবার আমার দিকে কৌতুকের চোখে তাকায়–আরও একটা ব্যাপার তুমি লক্ষ্য করেছ কি হেস্টিংস?
সেটা কি?
শনিবার ১২.০০ টার পর উনি অফিসে হাজির ছিলেন না।
.
০৭.
ট্রাজেডি
সন্ধ্যাবেলা আমরা এন্ড হাউসে হাজির হলাম। নিক আমাদের দেখে বিস্ময়ের গলায় বলে–ওহ আপনারা?
পোয়ারো বিনীত গলায় প্রশ্ন করে-আপনি কি কারও অপেক্ষায় রয়েছেন মাদাম জোয়েল?
নিক একটা ড্রাগন-ছাপ সাদা কিমানো পরেছিল। কিছুটা বিরক্ত গলায় ও বলে–আসলে বিকেলের মধ্যে আমার পোষাকটা পৌঁছে দেবার কথা ছিল। সেটা এখনও এল না। কিছুক্ষণ পরই বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। নিক দরজা খুলে দিল। এই যে ম্যাগি তুমি এসে গেছ তাহলে। আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হলেন সেই গোয়েন্দা এবং ওই ভদ্রলোক ওনার সহকারী। গোপন ঘাতকের হাত থেকে ওনারাই আমাকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। চল, আমরা সবাই বসবার ঘরে গিয়ে বসি। তারপর ওনারাই পুরো ব্যাপারটা তোমাকে বলবেন।
ম্যাগি বার্কলি আমাদের দুজনের সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমরা সবাই বাইরের ঘরে এসে বসলাম। প্রথম দর্শনেই মেয়েটির প্রতি আমার একটা বেশ ভাল মনোভাব জন্মাল। মেয়েটির চেহারায় ব্যক্তিত্ব এবং চালচলনে শান্ত ঠান্ডা আত্মবিশ্বাসের ছায়া আছে। এগুলোই আমাকে আকর্ষণ করল সম্ভবত। পুরানো সময়ের চোখে দেখলে নিঃসন্দেহে সুন্দরী বলা যায়। তবে–যদি আধুনিক সংজ্ঞা নিয়ে বিচার করা হয় তবে–না, মোটেই স্মার্ট বলা যাবে না মেয়েটিকে। কোনরকমে সাজসজ্জা, প্রসাধনের চড়া প্রলেপবিহীন একটি সরলতর মুখ। পোষাকও খুবই সাধারণ মানের। একটা কালো সান্ধ্য পোক।
গভীর নীল চোখ তুলে শান্ত গলায় ম্যাগি বলে–নিকের কাছে ঘটনার কথা সব জেনে আমি তো স্তম্ভিত হয়ে গেছি। একটু থেমে সে আবার বলে–সত্যি বলতে কি, ব্যাপারটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। কেউ কেন নিকের ক্ষতি করতে চাইবে? নিকের মত মেয়ের তো কোনও শত্রু থাকতে পারে না। মেয়েটির গলায় সত্যি সত্যি অবিশ্বাস ঝরে পড়ে। সেই অবিশ্বাস প্রতিফলিত হচ্ছিল পোয়ারোর দিকে মেয়েটির দৃষ্টিতেও স্বাভাবিক হয়তো। ম্যাগি বার্কলির মত সেকেলে ধারনার মেয়েদের কাছে। বিদেশী মানুষেরা সবসময়ই সন্দেহের বস্তু।
আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি মিস বার্কলি, ঘটনাগুলো সবই সত্যি বাস্তব। কোনও ভুল নেই–পোয়ারো শান্ত গলায় বলে। ম্যাগি কোন উত্তর দিল না বটে, কিন্তু ওর মুখের রেখায় অবিশ্বাসের ভাঁজগুলো সামান্যও পরিবর্তন হল না।
পোয়ারো এবার একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে–মিস বার্কলি, আপনি কি স্কটিশ?
আমার মা ছিলেন স্কটল্যান্ডে।
আপনার বোন সত্যিই খুব সাহসের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটাকে সামলাচ্ছেন। উনি আমাদের কথা দিয়েছেন, একদম স্বাভাবিক থাকবেন।
এবার আমি বলি,–সেটাই তো একমাত্র পথ।
তাই নাকি? ম্যাগি তার শান্ত অথচ ধারাল গলায় বলে।
মানে আমি বলতে চাইছি–মনের ভেতর যাই হয়ে চলুক, ঘটুক, বাইরের লোকেদের কাছে সেটা প্রকাশ করে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সবার জন্যেই সেটা অস্বস্তিকর।
আমাদের কথা আরও কিছুটা এগোবার সময় ফ্রেডরিকা রাইস ঘরে ঢুকলেন এবং ওকে অনুসরণ করে একটু পরেই লাজারুমও চলে এল। এরপর নিকও সেজেগুজে এসে হাজির হল। কৃষ্ণকালো একটা হাঁটুঝুল দুর্দান্ত ফ্রক পরেছে সে। কাঁধে জড়িয়েছে চীনা মাল। ভারি চমৎকার দেখাচ্ছিল ওকে।
শুভ সন্ধ্যা এবং স্বাগতম কটেল। সহাস্যে, খুশির ভঙ্গিতে বলল নিক।
আমরা সবাই গ্লাস হাতে নিলাম। নিকের স্বাস্থ্য কামনা করে চুমুক দিলাম। লাজারুম তার হাতের গ্লাসটা উঁচিয়ে ধরল–নিক, চমৎকার শাল। নিশ্চয়ই খুব পুরানো জিনিসটা?
হ্যাঁ, এটা আমার প্রপিতামহের তম্য প্রপিতামহ ওদেশে ভ্রমণ সেরে ফেরার সময়ে নিয়ে এসেছিলেন।
জিনিসটা সত্যি চমৎকার। এরকম জিনিস আজকাল আর পাওয়া যায় না।
জিনিসটা খুবই গরম। যদিও কালো রং আমার একেবারেই পছন্দ নয়।
ঠিকই তো। তোমাকে আগে কখনও কালো রং পরতে দেখিনি। আজ হঠাৎ কেন এটা পরলে?
জানি না। নিক কাঁধ ঝাঁকায়। ব্যাপারটাকে কিছুটা উড়িয়ে দেবার বেপরোয়া ভঙ্গি করে।
কিন্তু আমি ওর দু’ঠোঁটের ভাঁজে, তীক্ষ্ণতর অভিব্যক্তিতে দেখলাম স্পষ্ট বেদনা, হতাশার ছায়া। মানুষ কেন কি করছে সবসময় কি তা বুঝতে পারে? দার্শনিকতা ছুঁয়ে যায় নিকের পরের কথাগুলোতে।
এরপর আমরা রাতের খাবার খেতে গেলাম। লক্ষ্য করলাম একটি পুরুষ চাকরকে এই অনুষ্ঠানের জন্যে ভাড়া করা হয়েছে। লোকটার চেহারাটা আমার কাছে বেশ রহস্যজনক মনে হল। খাবার তেমন আহামরি কিছু নয়। শ্যাম্পেনটি সে তুলনায় বেশ ভাল।