মেয়েটি আবার একবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে একভাবে। পোয়ারো ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইঙ্গিত করে আমাকে চুপ করে থাকতে বলে। আমার মনে হয় ও আশা করছে কিছু একটা প্রতিক্রিয়া ঘটবে মেয়েটির মধ্যে। মেয়েটির আত্মনিয়ন্ত্রণ এবার হয়তো ভেঙে যাবে এবং সে এবার সত্যি কথা বলবে। কিন্তু তখনকার স্বর ও কথার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। যেন দূর থেকে স্বপ্নজড়ানো কোনও কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
আপনি জানেন, সবসময় চিরদিন আমি কি ভাবতাম? এন্ড হাউসকে খুব ভালবাসতাম আমি। সেখানকার পারিপার্শ্বিকে আমি একটা নাটক করব ভেবে এসেছি চিরদিন। নানারকম বিষয়ও ভাবতাম। অবশেষে, যেখানে সত্যিই এক নাটক ঘটছে, যা নাকি আমি পরিচালনা করছি না। যদিও সেই নাটকের মুখ্য চরিত্রে আমি। অথচ প্রথম অঙ্কেই আমার মৃত্যু লেখা রয়েছে। বলতে বলতে ওর গলা ভেঙে যায়।
না, না, মাদাম জোয়েল…….. পোয়ারো ব্যস্ত গলায় বলে–এভাবে বলবেন না। এটা এক ধরনের হিস্টিরিয়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নিমেষে, চকিতে ঘুরে ধারাল চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায় সে–ফ্রেডি নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছে, আমি হিস্টিরিয়াগ্রস্থ? তীক্ষ্ণ চোখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে গলায় কাঠিন্য এনে বলে, ফ্রেডি যা বলে সবসময় তা সত্যি বলে বিশ্বাস করে নেবার কোনও কারণ নেই।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর পোয়ারো যে প্রশ্নটা করে সেটা সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক। আমাকে একটা কথা বলুন তো মাদাম, আপনি কি কখনও এন্ড হাউস বিক্রি করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন?
না।
আপনি যদি ভাল দাম পান, বাড়িটা কি বিক্রি করে দেবার চিন্তাভাবনা করেছেন?
কয়েকমুহূর্ত নীরবতা……… তারপর নিক আবার কথা বলে-না, কখনও না। অবশ্য প্রস্তাবটা যদি অবিশ্বাস্য রকমের আকর্ষণীয় হয়, সেক্ষেত্রে বিক্রি না করাটা তো চরম বোকামি হবে, তাই না?
যদিও, আমি এই বাড়িটাকে এত ভালবাসি সেহেতু এটাকে বিক্রি করার কথা ভাবিই না।
আমি বুঝতে পারছি। নিক দরজার দিকে এগোতে থাকে–আজ রাতে বাজি পোড়ানোর উৎসব হবে। আপনারাও আসুন না। তারপর আমাদের সঙ্গেই ডিনার করবেন।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এত খুব আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হবে। পোয়ারো এক কথায় রাজি হয়ে যায়। সামান্য হেসে নিক ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
পোয়ারো এবার ওর টুপির দিকে হাত বাড়ায়। আয়নায় নিজেকে দেখে ঠিকঠাক মত টুপিটাকে মাথায় বসায়। কোটের ওপর হাত বুলিয়ে সেটা যথাযথ নিভাজ আছে কিনা পরীক্ষা করে নেয়।
আমি কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করি–কি ব্যাপার হে? আমরা কি কোথাও বের হচ্ছি?
অবশ্যই।
কোথায়?
কিছু আইনগত ব্যাপার………
আমি মাথা নাড়ি–ওহ, তাই তো, বুঝেছি।
মেসার্স ভ্যাইস, ট্রেভরনিয়ন অ্যান্ড উইনার্ডের অফিসটা শহরের প্রধান রাস্তায় অবস্থিত। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আমরা অফিসে প্রবেশ করলাম। তিনজন কেরানি সেই ঘরে কাজ ছিল। পোয়ারো তাদের একজনকে বলল যে মিঃ চার্লস ভ্যাইস-এর সঙ্গে দেখা করতে চায়। কেরানিটি পাশের একটা ফোন তুলে নিয়ে দু-চারটে কথা বলল, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল-আমার সঙ্গে আসুন। তিনি আমাদের একটা দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তারপর দরজাটা বাইরে থেকে টেনে খুলে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের ঢোকবার পথ করে দিলেন।
আমি সত্যিই আপনাকে ধন্যবাদ দেবার, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার মত এক বিদেশী আপনার পরামর্শ এবং মূল্যবান সাহায্য না পেলে সত্যি সমস্যায় পড়ে যেতাম। আইনি জটিলতা সত্যি এক বিরাট সমস্যা আমাদের মত সাধারণ মানুষদের কাছে।
মিঃ চালর্স ভ্যাইস এই সময়েই জানতে চাইলেন তার কাছে আমাদের কে পাঠিয়েছেন?
মিস বার্কলি, পোয়ারো সময় নষ্ট না করে উত্তর দেয়–তিনি আপনার সম্পর্কিত তাই না? সামান্য থেমে পোয়ারো আবার যোগ করে–সত্যি, অসাধারণ সুন্দর, চার্মিং মহিলা উনি। উনিই আপনার কথা আমাকে বলেছেন। আমি শনিবার ১২.০০–১২.৩০ নাগাদ আপনার কাছে দেখা করার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু শুনলাম আপনি বেরিয়ে গেছেন।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে, শনিবার আমি একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
আপনার বোন একা থাকেন। তিনি এতবড় বাড়িতে নিশ্চয়ই নিঃসঙ্গ বোধ করেন?
খুবই স্বাভাবিক।
যদি কিছু মনে না করেন মিঃ ভ্যাইস, একটা কথা জানাবেন? বাড়িটা কি বিক্রি হবার কথা আছে?
আমি তো অন্তত সেরকম কিছু জানি না। পোয়ারো দু’হাতের আঙুলগুলো জড়ো করে কিছু একটা ভাববার ভান করে, তারপর বলে–আসলে, আমি একটা এই ধরনের সম্পতি কেনার খোঁজে রয়েছি। পারিবারিক সম্পত্তি। ভ্যাইস মাথা ঝাঁকায়–আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ……… একটু থেমে সামান্য চিন্তা করে সে আবার বলে–আমার বোন তার এই পারিবারিক সম্পত্তির ওপর নিবেদিতপ্রাণ।
এর কয়েকমিনিট পর আমরা আবার রাস্তায় নেমে এলাম। তাহলে? প্রিয় বন্ধু, চার্লস ভ্যাইসকে দেখে তোমার কি মনে হল?
খুবই নেতিবাচক চরিত্র। তবে যথেষ্ট কৌতূহলজনক– আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বললাম। সেরকম শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষ নয়, বলছো?
পোয়ারো প্রশ্রয়ের গলায় প্রশ্ন করে–না, অবশ্যই নয়। উনি হচ্ছেন সেই ধরনের মধ্যমেধার মানুষ, যার সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের ইচ্ছে হবে না কারও।