এর মিনিটদশ পর আমরা ক্রফটের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। খুবই ভাল মানুষ। আমি রাস্তায় বের হয়ে বললাম। হুস, তোমার ওদের খুব পছন্দ হয়েছে তাই না।
পোয়ারোর কথায় আমি অবাক ভঙ্গিতে বললাম, কেন? তোমার পছন্দ হয়নি? পোয়ারো গভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। শুধু কয়েকটা খটকা………
খটকা? আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলি–পোয়ারো দিনে দিনেই তুমি সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ হয়ে উঠছ।
তুমি কি বলছ হেস্টিংস। একেবারে ঠিক। আমি সবাইকে সন্দেহ করি হেস্টিংস। সব কিছুকে সন্দেহ করি।
.
০৬.
মিঃ ভাইস
সোমবার, সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলাম, পোয়ারো একটা সুন্দর ড্রেসিং গাউন পরে বিছানায় বসে আছে।
হেস্টিংস। তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে নিয়ে তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।
বেশ খানিকটা বিস্ময় নিয়ে আমি বলি–কি কাজ?
আমি একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে রেখেছি। সেটা মাদাম জোয়েলের হাতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। আমি তৈরি হয়ে এসে যখন পোয়ারোর হাত থেকে চিরকুট নিতে যাব, ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে–হেস্টিংস, প্রিয় হেস্টিংস, কতদিন ধরে বলছি চেহারাটায় একটু গোয়েন্দাসুলভ গাম্ভীর্য যোগ কর। চুলের সিঁথিটা মাঝখান দিয়ে কর। একটুকরো দাড়ি রাখ থুতনিতে। আমার মত। একটু গোয়েন্দা সুলভ বানাও তোমার মধ্যবিত্ত চেহারাটাকে। আমার কথায় তো তুমি কান দেবার প্রয়োজনই মনে করও না। আমি গম্ভীর মুখে চিরকুটটা পোয়ারোর হাত থেকে নিলাম।
মিস বার্কলি এক তলায় বসবার ঘরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন। অন্য দিনের তুলনায় আজ তার চোখের কালি কিছুটা গাঢ় মনে হল। আমি পোয়ারোর চিরকুটটা তার হাতে তুলে দিলাম।
সকাল ১০টা নাগাদ মিস বার্কলি আমাদের হোটেলে এলেন। ওনার হাতে একটা টেলিগ্রাম। সেটা পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দেন-আশাকরি আপনি সন্তুষ্ট হবেন।
পোয়ারো টেলিগ্রামটা পড়ে। আমিও। পৌঁছচ্ছি। আজ ৫.৩০ বিকেলে। ম্যাগি। কিন্তু আপনি ভুল করছেন। ম্যাগির মস্তিষ্ক বলে কোনও বস্তুই নেই। কাজকর্মে খুব পটু ঠিকই। কিন্তু কোনও গুপ্তঘাতককে চিহ্নিত করতে পারবে, আমায় রক্ষা করবে, এটা ম্যাগির কাছে খুবই বেশি রকম দাবি করা হচ্ছে।
পোয়ারো উদাস ভঙ্গিতে বলে–আর কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার?
জর্জ?
এবার তীব্র বিদ্রূপ ভেসে ওঠে নিকের গলায়–জর্জ ওর নাকের ডগায় কিছু বসে থাকলেও তাকে দেখতে পায় না।
মিস বার্কলি এবার টুপিটাকে খুলে সোফার ওপরে ছুঁড়ে ফেলেন, আপনি যাকে ঢুকতে দেবার কথা চিরকুটে লিখেছেন, আমি বাড়িতে বলে এসেছি তাকে বিনা দ্বিধায় যেন ঢুকতে দেওয়া হয়। ব্যাপারটা কিন্তু বেশ রহস্যময় লাগছে আমার কাছে। আপনি কি গোপন মাইক্রোফোন জাতীয় কিছু বসাতে চাইছেন?
না, না, মাদাম, অত প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কোন ব্যাপার নয়। আমি খুব সামান্য একটা ব্যাপার শুধু জানতে চাই–ব্যাপারটা, বেশ মজার আর উত্তেজক।
হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবে। মিস বার্কলি উদাস ভঙ্গিতে বলে। আমাদের দিকে পিঠ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর যখন সে ঘুরে দাঁড়ায়, ওর মুখের বেপরোয়া ভাবটা সম্পূর্ণ উবে গেছে। অনেক কষ্টে চোখের জল ধরে রেখেছিল।
না, তা না। নিশ্চিতভাবেই নয়। আমার ভয় করছে। ভীষণ রকম ভয় করেছে। ওর মুখে এখন এক শিশুসুলভ অসহায়তা।
না, না, মাদাম, আপনি ভয় পাবার মতো মেয়েই নন। আমি এবং হেস্টিংস দুজনেই জানি সেটা।
না, এটা সাহস নয়। নিক সজোরে তার মাথা নাড়ে-বলতে পারেন এটা এক ধরনের শ্বাসরোধ অপেক্ষা কখন সেই অনিবার্যতাই ঘটবে তার প্রতীক্ষা করা এবং কিভাবে সেটা ঘটবে?
এটা পরিস্থিতির চাপ মাদাম। এসব নিয়ে অকারণ উত্তেজিত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
ছোট্ট চেয়ারটায় প্রায় ঢুকে বসেছিল নিক। ওর সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট হাতের আঙুলগুলো প্রবলতর নার্ভাসভাবে উদ্দেশ্যহীন নড়ে বেড়াচ্ছিল। পোয়ারো কয়েক পলক ঠান্ডা চোখ ওর সেই অস্থিরতা লক্ষ্য করে। তারপর শান্ত গলায় বলে–মাদাম, আমার মনে হয় আপনি কিছু বলতে চাইছেন। দয়া করে আমাকে সব কথা খুলে বলুন।
না, তেমন কিছু নয়, সেরকম কিছু নেই।
পোয়ারো নিরুত্তেজক শান্ত গলায় বলে-আপনি আমাকে কিছু একটা বলেননি। তাই না?
নিক সন্ত্রস্থ চোখে তাকায়। আমি আপনাকে ছোটখাট সব ব্যাপারটাই বলেছি।
দুর্ঘটনাগুলো, আপনার ওপর হামলার ব্যাপারে নিশ্চয়ই বলেছেন।
নিক বিভ্রান্ত চোখে তাকায়।
কিন্তু আপনি আমায় আপনার হৃদয়ের-মনের সব কথা বলেননি। আপনার জীবনের সবকিছু………
সেক্ষেত্রে কেউ তাহলে এটা করতে পারে?
আহ আপনি তাহলে সেকথা মেনে নিচ্ছেন? পোয়ারো সোৎসাহে বলে।
মেয়েটি সম্মতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। পোয়ারো খুব গভীর মনযোগের সঙ্গে ওর অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করার পর বলে-হয়তো তাই।
তাহলে? আমাকে বলবার মত আপনার কোনও কথা আছে–গোপন কিছু?
আমি খুঁটিয়ে ওকে লক্ষ্য করছিলাম। এক পলকের জন্য ওর চোখের পাতায় বিদ্যুতের ঝলক খেলে যেতে লক্ষ্য করলাম। তারপর দ্রুতই আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে এল নিক।
বিশ্বাস করুন, সত্যি সত্যি আমি আপনাকে সব কিছুই বলেছি–এই স্টুপিড় বিজনেসের সঙ্গে যা জড়িত। যদি আপনার মনে হয় আমি অন্য কারও বিষয়ে অন্য আরও কিছু জানি, তাহলে ভুল করছেন আপনি। আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি বোকা নই। আমি অবশ্যই বুঝতে পারছি, ওই দুর্ঘটনাগুলোর কোনটাই আসলে দুর্ঘটনা নয়। সেগুলো কারও দ্বারা ঘটানো হত্যার চেষ্টা এবং সেটা আমারই ঘনিষ্ঠতম কারও দ্বারা ঘটানো। আর সেটাই আমাকে কাঁটার মত বিধছে। কারণ আমার সামান্যতম ধারণাও নেই এটা কে হতে পারে অন্তত কে হওয়া সম্ভব, সেই ধারণাটুকুও নেই আমার।