পোয়ারো শূন্যে হাত দোলায়, ওর আঙ্গুলগুলোয় ঢেউ তোলে। প্রিয় হেস্টিংস, এক্ষেত্রে আমার যে প্রতিদ্বন্দ্বী তুমি কি বুঝতে পারছ না। আমাদের দু’হাত শক্ত করে বাঁধা। কোনও অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর যেটার সমাধান করা এরকুল পোয়ারোর কাছে কোনও সমস্যার ব্যাপার নয়। অপরাধী তো অপরাধের শরীরে তার নাম সই করে যায়। আমি সেটার পাঠোদ্ধার করি মাত্র। কিন্তু এক্ষেত্রে তো কোনও অপরাধ ঘটেই নি, এবং আমরা চাইও না–কোনও অপরাধ ঘটুক। কোনও অপরাধ ঘটবার আগেই তাকে নির্ণয় করা দুর্লভতম কঠিন কাজ।
পোয়ারো একটু থামে–আমাদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হল মাদাম জোয়েলের নিরাপত্তা। তাই তো? এবং সেটি মোটেও সহজ কাজ নয়। না, একেবারেই সহজ কাজ নয় হেস্টিংস। আমাদের পক্ষে দিন এবং রাত সর্বক্ষণ তার ওপর নজর রাখা সম্ভব নয়। আমরা কোনও পুলিশকেও নজরদারি করতে পাঠাতে পারি না। একজন যুবতীর শোবার ঘরে তো আমরা রাত কাটাতে পারি না।
পোয়ারো থামে, যেন দম নেয়–কিন্তু আমাদের সম্ভাব্য খুনির কাজটাকে আরও কঠিন করে তুলতে আমরা একটা কাজ করতে পারতাম। পোয়ারো থামে, এর বেশি কিছু বলবার দরকারও ছিল না। আমি তখন বেশ খুশি হয়ে উঠলাম এবং নিকের নিরাপত্তা কথা ভেবে নিশ্চিতবোধ করতে লাগলাম, ঠিক তখনই পোয়ারো কথা বলল আবার। এবং একেবারে ভিন্ন গলার স্বরে। আমি চমকিতবোধ করলাম কথাটা শুনে।
কিন্তু হেস্টিংস, আমার যথেষ্ট ভয় করছে।
সবিস্ময়ে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলি-ভয়?
হ্যাঁ, হেস্টিংস। ভয়! কারণ, লোকটা একেবারে শয়তান ধূর্ত। না হে, আমি একেবারে স্বস্তি পাচ্ছি না বন্ধু।
পোয়ারো, আমি তীক্ষ্ণ গলায় বললাম–তুমি আমাকে বেশ উদ্বিগ্ন করে তুলছ হে বন্ধু।
আমিও তোমার মত উদ্বিগ্ন হেস্টিংস, কেন জানো? স্থানীয় খবরের কাগজটিতে ছোট্ট একটা খবর বের হয়েছে। মাদাম জোয়েলের বাড়িতে বিখ্যাত গোয়েন্দা। এরকুল পোয়ারো ম্যাজিস্টিক হোটেলে উঠেছেন। হেস্টিংস, সবাই আমার নাম জানে আর ওতো ঝানু অপরাধী, সে তো আমার নাম জানবেই। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি আমার উপস্থিতি জানবার পরে তার কি করা উচিত?
অবশ্যই আত্মগোপন করা উচিত। পোয়ারোর আত্মগর্বকে উসকে দিয়ে আমি বলি–অযথা সে বৃথা সময় নষ্ট করবে না। পোয়ারো তদন্ত শুরু করার আগেই আমাকে যা করার করে ফেলতে হবে, ভেবে নিয়ে দ্রুত চরম আঘাত হানতে চাইবে–তাই নয় কি?
একটু থেমে পোয়ারো আবার যোগ করে–আর খবরের কাগজটা যেভাবে ভাঁজ করা ছিল, কেউ সেটা পড়েছিল। আর শুনলে তো হেস্টিংস, মিস বার্কলি বললেন–তিনি আজ খবরের কাগজ পড়েননি। তাহলে? কে পড়েছিল খবরের কাগজটা?
এবার আমিও বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম–তার মানে বাড়িরই কেউ………
নিঃসন্দেহে-হেস্টিংস, নিঃসন্দেহে।
তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?
পোয়ারো হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে শূন্যে ছোঁড়ে।
না, এই অপরাধের মোটিভ যাইহোক না কেন–সেটা দ্রষ্টব্য নয়। নিছক খুন করার কারণ কি হতে পারে? পুরানো বন্ধক রাখা এই বাড়ি? সম্পত্তি? হাস্যকর। তাহলে? তাহলে? তাহলে?
কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার? একমাত্র সন্দেহের তালিকায় ওকেই রাখা যায়।
পোয়ারো দৃঢ়ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে–নাহ, আমি জানি কেন তুমি একথা বলছ, তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস-কম্যান্ডারের সঙ্গে এই মামলার কোনও যোগাযোগ নেই। উনি একজন পাক্কা সাহেব।
কিন্তু পোয়ারো উনি মিস বার্কলি সম্পর্কে……..
আমায় শেষ করতে না দিয়েই পোয়ারো হাত তুলে বাধা দেয়। বন্ধু, আমার মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে উনি অন্যের মুখে শোনা কথা সত্যি বলে বিশ্বাস করে তোমার কাছে উগড়ে দিয়েছেন।
অন্যের মুখের কথা? সেটা কার হতে পারে?
পোয়ারো দুই আঙুলে গোঁফের একটা প্রান্তকে মোচড়াতে মোচড়াতে কৌতুকের গলায় বলে–সঠিক বলতে পারব না–হয়তো মিসেস রাইস।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম সেই গ্যারাজটিতে, যার কথা মিস বার্কলি উল্লেখ করেছিলেন।
পোয়ারো গ্যারেজ মালিককে নিজের পরিচয় দেয় মিস বার্কলির পরিচিত বলে, সঙ্গে একথাও বলে–মিস বার্কলির পরামর্শেই তিনি সেখান থেকে লঙ ড্রাইভেও যাবার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করতে এসেছেন। এসব কাজে কথাবার্তা চালাতে চালাতেই, সুচতুরভাবে কখন যেন ঢুকে পড়ে মিস বার্কলির গাড়ির গণ্ডগোলের প্রসঙ্গে।
গ্যারাজ মালিক যা বলল সেটা পুরোটাই যাত্রিক কথাবার্তা, কৌশলগত গাড়ির বিষয়। আমি সেই মোটর যানের নির্মাণ কৌশলের বিষয়ে পুরোপুরিই অন্ধ। পোয়ারো নিজেও এ বিষেয়ে খুব একটা বিজ্ঞ নয়। তবে তারই মধ্যে আমরা যা চাইছিলাম সেটা পেয়ে গেলাম। মোটর মেকানিক ও গ্যারাজ মালিকের কথার ভেতর থেকেই তা বেরিয়ে এল। নিকের গাড়িটা ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ বিগড়িয়েছিলেন এবং খুব সহজেই তা করা সম্ভব।
আমরা যখন রাস্তা ধরে হোটেলের দিকে ফিরছিলাম তখন পোয়ারো মন্তব্য করল–তাহলে, এই ব্যাপার?
একটু থেমে ভুরু কুঁচকে সে আবার বলে–নিক তাহলে ঠিক সন্দেহেই করেছিল।
তাহলে, এখন আমাদের কর্তব্য কি?
একটা টেলিগ্রাম করা। যদি না খুব বেশি দেরি হয়ে গিয়ে থাকে।
টেলিগ্রাম? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি।
হ্যাঁ, টেলিগ্রাম।
আমরা পোষ্ট অফিসে এসে হাজির হলাম। পোয়ারো টেলিগ্রামের বয়ান লিখল, সেটা পাঠিয়েও দিল কাকে, কোথায় কিছুই বলল না। ও হয়তো চেয়েছিল আমি প্রশ্ন করে জানতে চাইব। আমি সযত্নে যে পথ পরিহার করলাম।