আত্মস্থ হলেন এরকুল পোয়ারো। ঘোর কেটে যেতেই আবার কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হলেন।
খুব বেশি দূর যেতে হয়নি তাকে। অচিরেই শেষ হলো তার অনুসন্ধান। এতক্ষণ যে সম্ভাবনার আগুন তার মনের মধ্যে জ্বলছিল ধিকিধিকি, এখন তা নিভে গেল বুঝি।
দ্রুতবেগে যাত্রা পথ বেয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, টিলার ওপর একটা বাড়ি। চারপাশে বিরাট দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। দেওয়ালের গায়ে লাগানো আছে লোহার পেরেক। বিশাল কাঠের দরজা। দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন পোয়ারো। দরজার পাশেই প্রকাণ্ড লোহার কড়া। সাবধানে একটা শিকলে টান দিতেই দরজার ভেতর থেকে ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল। একটা মুখ হঠাৎ জেগে উঠলো। লুজ পাভাসী, সন্দিগ্ধ একখানি মুখ। ঠোঁটের ওপর পরিষ্কার গোঁফের রেখা। কিন্তু কণ্ঠস্বর জাঁদরেল স্ত্রীলোকের মতো।
–এটি কি সেন্ট মেরী গির্জা? প্রশ্ন করেন পোয়ারো।
মহিলা তির্যকভাবে জবাব দিলেন, তাছাড়া আর কি হতে পারে?
তার কথার জবাব না দিয়ে পোয়ারো বলেন, তিনি তার একবার সাক্ষাৎ পাবার অনুমতি পাবেন?
তার মধ্যে অনীহা দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন। অবশ্য রাজি না হয়ে তার কোনো উপায় ছিল না। এই পরিস্থিতির মধ্যে তাকে রাজি হতেই হবে। এমন ভাবেই হয়তো এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার পথ খুঁজে পাবেন তিনি।
অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলেন তাকে বিরক্ত করার জন্য মাফ চাইছেন। তার ধারণা তার ওখানে জনৈকা ধর্মপ্রাণা আছেন যাঁর পার্থিব নাম ফেটফেনা।
মধ্যবয়সী মানুষটি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, মিস্টার, মেরী ফেটফেনা।
এরকুল পোয়ারো বললেন, কিছু ভুল সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে মাদাম। তার বিশ্বাস মিস্টার উরসৃলা তাকে অনেক সাহায্য করতে পারবেন। তার দেওয়া কিছু খবর খুবই মূল্যবান হতে পারে।
মিস্টার উরসৃলা তাকে বেশ ভালোভাবে সাহায্য করতে পারবেন।
কিন্তু আপনাকে কথা দিচ্ছি… এ কথাটা সম্পূর্ণ বলতে গিয়ে মাঝ পথে থেমে পড়লেন মঠাধ্যক্ষা। বলে ওঠেন, মিস্টার, মেরী উরসৃলা দু মাস আগে মারা যান।
.
০৫.
মিমি আলোভ্যানের হোটেলের একটা পানশালায় ছিলেন এরকুল পোয়ারো। অন্য হোটেলের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। শোবার খাট ভাঙ্গা, জানালার দুটো কাঁচ নেই। রাতের হাওয়া তিনি ভয় পান। সেই হাওয়াই ঘরের ভেতর ঢুকতে চাইছে। গরম জল ঈষৎ উষ্ণ। খাদ্যদ্রব্য অত্যন্ত অরুচিকর।
পানশালায় পাঁচজন মানুষ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। আচমকা পোয়ারো লক্ষ্য করলো ওদের মধ্যে একজন তার পাশে এসে বসল।
লোকটা পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলো।
অনেক কথাই বলার ছিল তার তবু সব কথা সে গুছিয়ে বলতে পারল না। অনেক কথা বাকি থেকে গেল।
সে সারা বছর ধরে প্রত্যেককে জিতিয়ে চলেছে। তার কথা শুনে পোয়ারো বললেন, পস্তাবে না।
সম্ভ্রম ভরা দৃষ্টিতে পোয়ারো বললেন, এখন আমাদের কাজ শুরু হোক। অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে।
.
০৬.
কয়েক ঘন্টা পরে মেঘের আড়ালে চাঁদ লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত। পোয়ারো এবং তার নতুন বন্ধু কয়েক মাইল হেঁটে চলেছে।
তার সঙ্গী ভদ্রলোকটি হঠাৎ বলে উঠল, এই ভাবেই কি যাজকরা ওদের পিছু নেবেন? তিনি বিবেকের দংশনে জর্জরিত হচ্ছেন।
এরকুল পোয়ারো উত্তরে বলেন, আপনি আর এমন কি বেশি করেছেন। নিজের জিনিষ ফিরিয়ে দিয়েছেন মাত্র।
দুজনেই মঠের কাছে পৌঁছতেই অ্যাটলাসের মুখ থেকে চাপা আর্তনাদ ভেসে এলো।
কর্তৃত্বজনক সুরেই জবাব দিলেন পোয়ারো, শান্ত হোন। সারা পৃথিবীর ভার আপনাকে নিতে হবে না, শুধু মাত্র এরকুল পোয়ারোর ভার নিলেই চলবে।
.
০৭.
অ্যাটলাস দুটো পাউণ্ডের নোট নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল।
কোন আশা নিয়েই বলল, সকাল হলেই টাকাটা কি ভাবে রোজগার হয়েছে মনে থাকবে না। তবে টাকা আসার কথা পেলে তবে পেছনে ছুটবেন।
বিড়বিড় করতে চাইল অ্যাটলাস, টাকাটা আমার ভীষণ প্রয়োজন। টাকার জন্যে তো আমাকে এ জীবন কাটাতে হচ্ছে। আমি জানি এখানে টাকা রোজগার করা কত শক্ত। তবু আমি টাকার পেছনে ছোটার চেষ্টা করছি।
এর উত্তরে পোয়ারো অর্থপূর্ণ হাসি হাসলেন। তাঁর বিচিত্র স্মৃতির ভাণ্ডারে এমন অনেক মানুষের সন্ধান তিনি পেয়েছেন যারা টাকার জন্যে পরিশ্রম করে, কিন্তু বিনিময়ে কি পায় তারা সম্মান? সুখ, শান্তি?
এ লোকটিরও হয়তো সেই পরিণতি হবে একদিন।
.
০৮.
অতি সাবধানতা নিয়েই এরকুল পোয়ারো নিখুঁতভাবে কাগজে জড়ানো মোড়কটা খুললেন। ডেস্কের ওপর রাখলেন উজ্জ্বল পানপাত্রটি। পানপাত্রের উপর খোদাই করা সবুজ পান্না খচিত আপেলসহ একটা গাছ।
পোয়ারোকে অভিনন্দন জানিয়ে এথেরি পাওয়ার পানপাত্রটির ওপর তার স্পর্শ অনুভব করতে করতে বললেন–এটা আমার।
এরকুল পোয়ারো স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, এটা আপনার।
কোথায় পেলেন জিনিষটা?
উত্তর দিল পোয়ারো, একটা বেদীর ওপর–
এরপর পোয়ারো বলে, ফেসীর মেয়ে সন্ন্যাসিনী ছিল, তার বাবার মৃত্যুর সময় সে শেষে ঐ পাত্রটা গ্রহণ করেছিল। সে অজ্ঞ হলেও সৎ ছিল। পানপাত্রটি লিভারপুলের বাড়িতে লুকোনো ছিল। বাবার কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতেই সেটা সঙ্গে নিয়ে যায় সে। সেটিকে ঈশ্বরের সেবায় দান করে। তার ধারণা মঠবাসীরা কেউ তার আসল মূল্য জানত না। তারা সেটিকে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে মনে করতো।
এথেরি পাওয়ার বিস্মিত হয়ে বলেন, সেখানে যাবার কথা তার মনে কেন জাগলো?