ইলিয়া যেন কেমন ঘোরের মধ্যে পড়েছে মনে হল। বলল, শুধুই মোটর দুর্ঘটনা, না অন্য আরো
-পথেঘাটে বিশেষ করে এরকম পাহাড়ী পথে কতরকমের দুর্ঘটনাই ঘটতে পারে। কিন্তু গ্রামের মানুষের তিলকে তাল করে তোলাই স্বভাব। এভাবেই অভিশাপ শব্দটা এই জায়গাটার কপালে জুটেছে।
–এখন বুঝতে পারছি, এই কারণেই সম্পত্তিটার দাম উঠছে না।
ইলিয়ার গলার স্বর কাঁপছিল। লক্ষ্য করে বললাম, অনেকটা পথ যেতে হবে। চল তাড়াতাড়ি নেমে পড়া যাক।
চলতে চলতেই এক ফাঁকে বলে ফেললাম, আগামীকাল আমার একবার মার্কেট কডওয়েলে যাবার কথা আছে। সেখানে আমাদের কি আবার দেখা হতে পারে?
ইলিয়া বলল, তা সম্ভব হতে পারে। সন্ধ্যার ট্রেনে লণ্ডনে ফিরে যাব আমি। বিকেলে দেখা হতে পারে।
–তাহলে কোন কাফেতে–ব্লু ডগ অথবা
ইলিয়া হঠাৎ অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। কি জানি কেন। পরে বলল, ব্ল ডগ খুবই ভাল কাফে–ঠিক আছে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আমি সেখানে পৌঁছে যাব।
ইলিয়া সহজভাবে সাড়া দিয়ে আমাকে শঙ্কামুক্ত করল। আমি উল্লাসভরে বলে উঠলাম, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব।
ততক্ষণে আমরা গ্রামের প্রান্তে এসে পৌঁচেছি। পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেবার লগ্ন এসেছে। সহসা ইলিয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আচ্ছা জায়গাটা কি সত্যিই ভীতিজনক?
আমি এবারে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলাম। বললাম, জিপসি বুড়ির প্রলাপগুলো দেখছি এখনো তোমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
এখানে ভয় পাবার মত তো কিছুই আমার নজরে পড়ল না। গ্রামের লোকে যাই বলুক জিপসি একর আমার খুব পছন্দ হয়েছে। মনের মত বাড়ি বানাতে হলে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশই উপযুক্ত।
.
পরদিন বিকেলে মার্কেট কডওয়েলে আবার আমাদের দেখা হল। চা খেতে খেতে আমরা গল্প করলাম। কিন্তু নিজেদের সম্পর্কে কথা বিশেষ হল না। বাইরের নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতে করতেই সময় কেটে গেল।
কথায় কথায় ইলিয়া জানাল, গতকাল যে গাড়িটার কথা বলেছিল সেটা তার নিজের গাড়ি নয়। তবে সেটা কার সেকথা খুলে বলল না।
সাড়ে পাঁচটায় ইলিয়ার গাড়ি ছাড়বার কথা। তার অনেক আগেই আমরা উঠে পড়লাম। চায়ের বিল আমি মিটিয়ে দিলাম।
ইলিয়া একসময় বলল, আগামী দু সপ্তাহ আমি লণ্ডনেই আছি।
তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আমার ভাল লাগল। বললাম, তাহলে কোথায় কখন
.
তিনদিন পরে রিজেন্ট পার্কের নির্ধারিত স্থানে আমাদের দেখা হল। এই নিয়ে তৃতীয়বার।
দিনটা ছিল ঝকঝকে। একটা রেস্তোরাঁয় বসে আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম, তারপর কুইন মেরীর বাগানে কিছু সময় ঘুরে বেড়ালাম। তারপর বাগানের এক নির্জন প্রান্তে ডেক চেয়ারে বসে গল্প জুড়লাম।
আজ আমি ইচ্ছে করেই নিজের ব্যক্তিগত কথা কিছু বললাম। খুব সাধারণ একটা স্কুলে আমি লেখাপড়া শিখেছিলাম।
স্কুল ছাড়ার পরেই শুরু হয়ে যায় আমার বিচিত্র বর্ণময় জীবন। একটা অন্তর্নিহিত অস্থিরতা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে।
কোন একটা কাজে বেশি দিন লেগে থাকতে পারতাম না। কিছুদিন পরেই একঘেয়ে লাগত। সবকথাই আমি খুলে বললাম।
ইলিয়া আমার যাযাবর জীবনের কাহিনী শুনে উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, আমাদের দুজনের জীবনধারা দেখছি একেবারে বিপরীত।
আমি হালকা সুরে বললাম, তুমি ধনী মহিলা—
কিন্তু ভাগ্যহত।
–ভাগ্যহত?
–হ্যাঁ।
এরপর একটু একটু করে নিজের জীবনকাহিনী শোনাল ইলিয়া। ওদের বিপুল সম্পদের কথা, সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ধনীদের জীবন যে কত ক্লান্তিকর, দুর্বিষহ সবই খুলে বলল।
আভিজাত্যের কৃত্রিম বেড়াজাল চারপাশে। নিজের খেয়াল খুশিমত সেখানে কোন কিছু করার সুযোগ নেই। বন্ধুবান্ধব নির্বাচনের ব্যাপারেও স্বাধীনতা থাকে না। সারাক্ষণ মাপাকথা, মাপাহাসি।
পুতুলের মত হাত পা নেড়ে কেবল নিয়ম রক্ষা করে যেতে হয়। পাছে মুখোস না একটু খসে পড়ে সেজন্য আশপাশের সকলের সদাসতর্ক নজর আর খবরদারি। খুব অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছে ইলিয়া। বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন। বছর কয়েক আগে বাবাকেও হারিয়েছে সে। ঘরে এখন সৎমা।
স্পষ্ট করে না বললেও বুঝতে অসুবিধা হল না যে সম্মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক মধুর নয়। ভদ্রমহিলা বছরের অর্ধেকটাই কাটান আমেরিকায়। বাইরে ঘুরে বেড়ানোটাই তার জীবন।
আমার কাছে ওর জীবন এক অবিশ্বাস্য যন্ত্রণার জীবন বলেই মনে হল। প্রভূত বিত্তের মালিক হয়েও কৃত্রিম নিয়মের নিগঢ়ে দুঃসহ বন্দিজীবন।
সমগ্র পরিবেশ, আনন্দ অনুষ্ঠান, কোথাও আনন্দের ছিটেফোঁটা নেই শুনতে শুনতে আমার যেন দম আটকে আসতে লাগল।
সব শুনে মনে হল বাস্তবিকই আমাদের দুজনের জীবনে কোথাও মিল নেই এতটুকু। দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা–কথাটা আমাদের জন্যই যেন তৈরি হয়েছিল।
-তাহলে তো দেখছি তোমার কোন বন্ধু নেই, আমি বিস্ময় প্রকাশ করলাম, পুরুষ বন্ধুও কি নেই?
বন্ধু কেউ নেই। বাছাই করা এমন পুরুষদের সঙ্গে আমাকে মিশতে দেওয়া হয় যে তাদের সঙ্গ বড় বৈচিত্র্যহীন ক্লান্তিকর।
-বন্ধু ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে? তোমার প্রাণের বন্ধু—
একজন তেমন আছে–গ্রেটা তার নাম।
–গ্রেটা কে?
-আমাকে জার্মান ভাষা শেখাবার জন্য গ্রেটাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। মেয়েটি অন্য সকলের চেয়ে একেবারেই আলাদা। সে আমাকে নানাভাবে সাহায্যও করে।