এখানে কারোর কোনদিন মঙ্গল হয়নি। তাই তো তোমাদের বলছি, এখানে এভাবে ঘুরে বেড়ানোটা তোমাদের পক্ষেও শুভ হবে না।
ইলিয়া মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গেল। পরে শান্ত সংযত কণ্ঠে বলল, এ জায়গাটা নিলাম হচ্ছে শুনলাম তাই দেখতে এলাম। চমৎকার জায়গাটা। খুবই ভাল লাগল।
বুড়ি কর্কশ কণ্ঠে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, শোন বাছারা, এ জমি কেনার মন করো না। যে কিনবে জমির সঙ্গে দুর্ভাগ্যও তার ঘাড়ে চাপবে।
তোমাদের দুটিকে দেখতে বেশ সুন্দর। তাই তোমাদের ভালর জন্যেই বলছি, এখানে ঘোরাঘুরি করে নিজেদের দুর্ভোগ ডেকে এনো না।
বহু যুগ আগে থেকে এ এলাকা অভিশপ্ত হয়ে আছে। যে কিনবে তার কখনো মঙ্গল হবে না। জিপসি একর থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করবে। মনেও ঠাই দিও না। আমি জানি এখানে বাতাসের সঙ্গে মিশে আছে মৃত্যুর হিম নিশ্বাস। মরবে-নির্ঘাৎ মরবে যে এখানে আসবে।
যারা এসেছিল সব মরে ভূত হয়ে গেছে। মনে রেখো এটা জিপসি বুড়ির সতর্কবার্তা।
গায়ে কাঁটা ধরানো বুড়ির কথাগুলো ধৈর্য ধরে শুনল ইলিয়া। পরে বলল, আমরা তো কারো ক্ষতি করছি না।
আমিও এগিয়ে গিয়ে বললাম, শোন বুড়ি, কেন তুমি মিছে এই মহিলাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ! আমরা তো চলেই যাচ্ছি।
পরে ইলিয়াকে বললাম, বুড়ি লী এই গ্রামেই থাকে। বুড়ির গুণও কম নয়। ভাল হাত দেখতে জানে। কি বল মিসেস লী?
বুড়ি জবাব দিল, হা, সে ক্ষমতা আমার কাছে। আমাদের জিপসি সম্প্রদায়ের সকলেই জন্মসূত্রে এই ক্ষমতার অধিকারী। তোমার দুহাতের তালু দুটো মেলে ধরো তো মেয়ে, তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের ভাল মন্দ সব খবরই আগাম জানিয়ে দেব। কেবল একটা রৌপ্য মুদ্রা আমার মজুরি।
ইলিয়া বলল, কিন্তু আমি তো আমার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা কিছু জানতে চাই না।
–নারে মেয়ে, ওটা বুদ্ধিমানের কথা নয়। আগে থেকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানা থাকলে বিপদ আপদ ঘায়েল করতে পারে কম, তাই না? ভবিষ্যৎ শুনলেই ঘাবড়ে যাবার কি আছে। তোমার তো অঢেল টাকা।
ওই কোটের পকেটেও টাকার অভাব নেই। কি করে চললে মঙ্গল হবে, সব আমি তোমাকে বলে দেব।
আমি কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি মেলে ইলিয়ার দিকে তাকিয়েছিলাম। ভবিষ্যৎ জানার ব্যাপারে মেয়েদের দুর্বলতা আমি আগাগোড়া দেখে এসেছি।
ইলিয়াও তার ব্যতিক্রম হল না। নিজের ব্যাগ খুলে আধ ক্রাউনের দুটো মুদ্রা বের করে বুড়ির হাতে দিল।
–এই তো সোনা মেয়ে। তোমার উপযুক্ত কাজই তুমি করেছ। এবার জিপসি বুড়ির কথা মন দিয়ে শোন। বলে হাতের থাবা পাতল।
ইলিয়া পশমের দস্তানা খুলে বাম হাতের পেলব তালু সামনে মেলে ধরল।
হাতটা চোখের সামনে টেনে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে বুড়ি খানিকক্ষণ রেখাগুলো দেখল। দেখতে দেখতে তার ক্লিষ্ট বলিরেখাঙ্কিত মুখমণ্ডলে অদ্ভুত থমথমে ভাব ফুটে উঠল। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগল–এ আমি কি দেখছি–এ আমি কি দেখছি
বলতে বলতে ইলিয়ার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, যত শীঘ্র পার এখান থেকে পালিয়ে যাও।
জিপসি একর তোমাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। এখানকার অভিশাপের কথাতো তুমি শুনেছো, তবু কেন এলে?
তোমার হাতের রেখা আমাকে স্পষ্ট অশুভ কথা বলছে। এখনো সময় আছে অভিশপ্ত জিপসি একর ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাও।
ভুলেও কখনো মনে করো না। জিপসি বুড়ি লীর কথা অগ্রাহ্য করো না, তাহলে তোমার মঙ্গল হবে না। এখানকার বাতাসে অভিশাপের বিষ ছড়িয়ে আছে, গায়ে লাগলে রক্ষে নেই।
বুড়ি, তুমি দেখছি, সকলকেই ভয় দেখিয়ে জিপসি একর থেকে তাড়াতে চাইছ। এই মহিলা নেহাৎ বেড়াতে বেড়াতেই এখানে চলে এসেছেন। জিপসি একরের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।
রীতিমতো ধমকের সুরেই বললাম বুড়িকে।
বুড়ি কিন্তু আমার কথা কানেই তুলল না। সে ইলিয়াকে লক্ষ্য করে বলেই চলল, তোমার মঙ্গলের জন্যই তোমাকে সাবধান করে দিতে চাইছি মেয়ে।
তোমার দয়ার শরীর। সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই তুমি জন্মেছ। কিন্তু বিপদ সম্পর্কে সাবধান না হলে সেই সুখও টেকে না। আমার কথা মনে রেখো, যে জায়গা অভিশপ্ত, বিপজ্জনক, তেমন জায়গায় কখনো পা দেবে না।
সবসময় সতর্ক থাকবে, সাবধানে চলাফেরা করবে। আমার এই নির্দেশ যদি অগ্রাহ্য কর তাহলে কিন্তু-না সে কথা আমি ভাবতেও চাই না। না না, তোমার হাতের ওই রেখাগুলো আর দেখতে চাই না।
বুড়ি লীর হাত কাঁপছিল। সে ইলিয়ার দেওয়া মুদ্রা দুটো অদ্ভুত ভঙ্গীতে আবার তার হাতেই গুঁজে দিল।
তার মুখে কিন্তু বিরাম ছিল না। স্বগতোক্তির মত কি যে বলে চলেছে, সব বোঝা যাচ্ছিল না। কয়েকটা টুকরো কথা কেবল কানে এলো–হ্যায় বিধাতা–একী তোমার খেলা–নিয়তি কি নিষ্ঠুর কেউ রেহাই পায় না।
জিপসি বুড়ি লী আর সেখানে দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে গেল।
ইলিয়া বুড়ির গমনপথের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। স্বগতোক্তির মত তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো–বাপরে, কি সাংঘাতিক বুড়ি।
ইলিয়াকে স্বাভাবিক করে তুলবার জন্য বললাম, বুড়ির মাথার ঠিক নেই। সকলকে ভয় দেখানোর বাতিকগ্রস্ত। এসব কথার কখনো গুরুত্ব দিতে নেই।
ইলিয়া জানতে চাইল, এখানে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, তাই না?
–এই রাস্তার কয়েকটা বাঁক খুবই বিপজ্জনক। তাছাড়া রাস্তাটাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক সরু। দুর্ঘটনা ঘটবার মত জায়গাই এটা। অথচ স্থানীয় পৌরপ্রশাসন মনে হচ্ছে এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয়। এদের নামে মামলা করা উচিত।