আমার ব্যবহারে শিষ্টাচারের ব্যাঘাত ঘটল কি না সেকথা সেই মুহূর্তে মনে হল না। কেন মেয়েটিকে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়া ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য আমার ছিল না।
সে সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিল। তাকে আমি পাশেই একটা জায়গায় নিয়ে এলাম।
এরপর তাকে সমুদ্রে যাবার আঁকাবাঁকা পথ, সারিবদ্ধ পাহাড়ের চুড়ো, তাদের কোলে ছোটখাট শহরটি, দুপাশে পাহাড়ের মধ্যে সবুজ আরণ্যক উপত্যকা, সব একে একে দেখিয়ে দিলাম।
পরিবেশের প্রভাবেই আমি হয়তো কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। বললাম, এই মনোমুগ্ধকর পটভূমিতে ফাঁকা জমির ওপর ঠিক প্রকৃতির অঙ্গ করেই বড় সুন্দর একটা বাড়ি তৈরি করা যায়।
তবে যথার্থ প্রতিভাবান স্থপতি হলেই তেমন একটি বাড়ি তৈরি সম্ভব হবে।
মেয়েটি মুগ্ধ হয়ে আমার কথা শুনছিল। কথা শেষ হলে বলল, তেমন দক্ষ স্থপতি কি আপনার জানা আছে?
–তেমন একজনকে অবশ্য আমি জানি। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
কথা বলতে বলতে একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পাশাপাশি বসলাম আমরা। আমি তাকে স্যানটনিক্সের কথা বললাম। প্রসঙ্গক্রমেই আমার সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎকার কালের কথাগুলোও এসে পড়ল।
নবপরিচিতা মেয়েটির সঙ্গে এভাবেই কথা বলতে যেন অতি সহজেই অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠল। আমাদের সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে পৌঁছে গেল। সম্ভবতঃ পরিবেশই এভাবে অতি সামান্য সময়ের মধ্যে আমাদের দুজনকে কাছে এনে দিল।
সেই পাহাড়ী নির্জন পরিবেশে একজন সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে সহজ অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলার সুযোগ পাব, এখানে আসার আগে ভুলেও চিন্তায় আসেনি।
আমরা দুজনেই দুজনের কাছে অপরিচিত। কোনদিন কেউ কাউকে দেখিনি পর্যন্ত। কিন্তু তবু আলাপ পরিচয়ের ফাঁকে তার কাছে আমি আমার নানান রঙিন স্বপ্নের কথা নিঃসঙ্কোচেই খুলে বলতে পারলাম।
আমার আবাল্যপোষিত মনের মত একখানি বাড়ির কথা শুনে ইলিয়া বলল, এমন একটা বাড়ির সাধ বহুদিন থেকে আমিও মনে পোষণ করে রেখেছি। এখন মনে হচ্ছে এরকম একটা পরিবেশই আমার স্বপ্নের মধ্যে ছিল।
সত্যিই একেবারে প্রকৃতির নিজস্ব লীলানিকেতন। শহরের যন্ত্রণাময় কোলাহল এখানে পৌঁছবে না, নগরজীবনে কৃত্রিমতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে শিষ্টাচার আর রীতিনীতির বেড়াজালের বাইরে একান্ত নিজের মত করে বেঁচে থাকার ইন্ধন এখানে ভরপুর।
এখন মনে হচ্ছে এটাই আদর্শ জায়গা। আমিতো রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছি।
আমি আর ইলিয়া–দুজনের প্রথম পরিচয়ের সূত্রপাতটা এভাবেই হয়েছিল।
সেদিন ইলিয়াই প্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার নাম?
বলেছিলাম, মাইকেল রজার। তুমি মাইক বলে ডেকো।
-তোমার নাম তো বললে না।
–আমার? কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলেছিল, ফিনেলা, ফিনেলা গুডম্যান।
ওকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে আমার সন্দেহ হল, ওকি আমাকে আসল নাম গোপন করল? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, মনগড়া নাম কেন বলতে যাবে, আমিতো তাকে আসল নাম গোপন করিনি। আমার ধারণাটা ঠিক নয়।
সেদিন খুব বেশি কথা না হলেও যতক্ষণ কাছাকাছি ছিলাম, দুজন দুজনকে লক্ষ্য করেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম দুজনেরই অনেক ব্যক্তিগত কথা বলার ছিল, কিন্তু প্রথম দিনেই মানসিক আড়ষ্টতা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আর সেই কারণেই কবে আবার দেখা হতে পারে, কোথায় দেখা হতে পারে, কে কোথায় থাকি এসব কথা জিজ্ঞেস করবার সাহস পাচ্ছিলাম না।
ফাঁকা জায়গায় ঠাণ্ডাটা ক্রমেই বেড়ে উঠছিল। তাই একসময় আমরা সেই প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ছেড়ে নিচে নেমে চললাম।
চলতে চলতে আচমকাই আমি প্রশ্ন করে বসলাম, মিস গুডম্যান, তুমি কি আশপাশেই কোথাও থাক?
ফিনেলা জানালো সে মার্কেট কডওয়েলের একটা হোটেলে উঠেছে। আমি অনুমান করলাম এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরের বাণিজ্যকেন্দ্র কডওয়েলের কোন অভিজাত হোটেলেই সে উঠেছে।
পরক্ষণেই আমাকে ও জিজ্ঞেস করল, রজার, তোমার বাড়ি কোথায়?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, আমি থাকি অনেক দূরে। কেবল আজকের জন্যই এখানে এসেছিলাম।
সামনের গ্রামের একটা সরাইখানার ধারে ফিনেলা তার গাড়ি রেখে এসেছিল। সেই অবধি আমরা গল্প করতে করতে হেঁটেই যাব ঠিক করলাম।
পাহাড়ী রাস্তাটা সাপের মত এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে। এই পথেরই একটা মোড় দুর্ঘটনার জন্য কুখ্যাত হয়েছে।
খানিকটা পথ এগুবার পর একটা বাঁকের মুখে আচম্বিতে আমাদের চোখের সামনে একটা ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হল। একটা ঝকড়া মাথা ফার গাছের আড়ালে ছিল, সেখান থেকেই পথের ওপরে এসে দাঁড়াল মূর্তিটা।
ইলিয়া আর্ত চিৎকার করে পেছনে সরে এল। আমিও প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম। পরে ভাল করে তাকিয়ে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার আগের দেখা সেই জিপসি বুড়ি লী।
তার চেহারা আজ আরও বেশি উগ্র আর ভয়ঙ্কর। মাথার রুক্ষ চুলের রাশি সাপের লেজের মত বাতাসে উড়ছে। গায়ে একটা লাল রঙের পোশাক।
খনখনে গলায় বুড়ি প্রশ্ন করল, এই জিপসি একরে এসেছ কি উদ্দেশ্যে? দুটিতে মিলে জোড় বেঁধেছ?
জবাবটা দিল ইলিয়াই। বলল, কেন, এতে দোষের কি হল? তাছাড়া কারুর জমিতেও আমরা বেআইনী প্রবেশ করিনি।
-এটা ছিল আমাদের এলাকা–মানে জিপসিদের। সেই জন্যেই জায়গাটার নামও হয়েছে জিপসি একর। কিন্তু, জানতো ওরা জিপসিদের থাকতে দেয়নি। গায়ের জোরে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে পুরো এলাকা দখল করে নিয়েছে। সেই থেকে এখানকার হাওয়ার সঙ্গে জিপসিদের অভিশাপ মিশে আছে।