যারা নিলাম ডাকতে উপস্থিত হয়েছিল তারা সকলেই সম্ভবতঃ স্থানীয় গ্রামাঞ্চলের অধিবাসী। এদের মধ্যে একজনই ছিল পোশাক-আসাকে ফিটফাট, কেতাদুরস্ত। সম্ভবত লণ্ডন থেকে সরাসরি চলে এসেছিলেন। তিনি অবশ্য নিলাম ডাকাডাকির মধ্যে সক্রিয় ভূমিকা নেননি।
পাঁচ হাজারের বেশি দর উঠল না। নিলামদারের মুখে কেমন একটা হতাশার ভাব ফুটে উঠল। সে ঘোষণা করল এই সম্পত্তির জন্য ন্যূনতম যে দাম বাঁধা ছিল ডাক সেই পর্যন্ত না পৌঁছনোর ফলে আজকের মতো নিলাম বন্ধ রইল।
ফিরে আসার পথে এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, সবটাই পণ্ডশ্রম হল। জানতাম এরকমই হবে। আপনাকে তো নিলামে অংশ নিতে দেখলাম না।
আমি জানালাম, তেমন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আমি আসিনি। ব্যাপারটা কিরকম ঘটে সে সম্পর্কে একটা কৌতূহল ছিল, তাই এসেছিলাম।
ঘরবাড়ি জমিজমা নিলামের ক্ষেত্রে এরকমই হয়। ওরা এভাবে জেনে নিতে চায়, সম্পত্তিটার বিষয়ে আগ্রহী কারা কারা। এখানে যা দেখা গেল, তিনজনের সামান্য কিছু আগ্রহ আছে।
আমি জানতে চাইলাম, এরা কারা কারা?
–একজন হলেন হেলমিনস্টার গ্রামের মিঃ ওয়াটারবি। জমি কেনা বেচার ব্যবসায় ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই বেশ মোটা পয়সা কামিয়ে নিয়েছে। লিভারপুলের এক নামী সংস্থার প্রতিনিধিকেও দেখলাম। লণ্ডন থেকেও এসেছিলেন একজন।
যারা যারা এসেছিলেন নিলাম ডাকতে তাদের মধ্যে এই কজনই প্রধান।
ভদ্রলোক কয়েক পা নীরবে হাঁটলেন। তারপর বললেন, দাম বেশি পাবে না, খুব কম দামেই সম্পত্তিটা বিক্রি হয়ে যাবে দেখবেন।
–জায়গাটার একটা দুর্নাম আছে শুনেছিলাম।
–তাহলে আপনিও শুনেছেন জিপসি একরের কাহিনীটা। ওসব মশায় গ্রামের অশিক্ষিত লোকজনের গালগল্প। তবে পথের বাঁকটা বাস্তবিকই একটা মরণ-ফাঁদ বিশেষ। স্থানীয় পৌরকর্তৃপক্ষ যদি রাস্তাটাতে আরও চওড়া করে ধারে ধারে লোহার রেলিং বসিয়ে দিত তাহলে অতটা বিপজ্জনক থাকত না।
-শুনেছি ওই এলাকাটা নাকি অভিশপ্ত। জিপসিরা নাকি জমিটা ছেড়ে যাবার সময় কি সব অভিশাপ দিয়ে গেছে।
–ওসবে কান দেবেন না মশায়। নিতান্তই গ্রাম্য মানুষের কুসংস্কার। ওসব তোয়াক্কা করলে কি আর লিভারপুলের অতবড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে লোক আসে। মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে ওরাই কিনে নেবে।
অতবড় প্রাচীন প্রাসাদ ভেঙ্গে ফেলে তার ওপর আধুনিক ধাঁচের বাড়ি করা কিরকম ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার বুঝতে পারছেন! কজনের সামর্থ্যে কুলোবে বলুন।
আজকাল লোকে বনেদী অঞ্চলে ফ্ল্যাট কেনাটাই বেশি পছন্দ করে। অত জায়গা নিয়ে বাগানবাড়ির দিকে ঝোঁক নেই কারো।
–আধুনিক ছাঁদের বাড়ি তো এই জমিটার ওপরেও তৈরি করা চলে।
–তা যায়। কিন্তু শহর এলাকা ছেড়ে অমন নির্জন জায়গায় কে বসবাস করতে আসবে বলুন।
এরপর ভদ্রলোক বিদায় নিয়ে বাঁদিকের পথ ধরলেন। আমি যেমন চলছিলাম, তেমনই সোজা চলতে লাগলাম।
কোথায় যাব সে বিষয়ে কোন ধারণা ছিল না আমার। আপনা থেকেই যেন পা জোড়া আমাকে টেনে নিয়ে চলেছিল সর্পিল পাহাড়ী পথে।
এই ছায়াঘেরা পাহাড়ী পথেরই এক বাঁকের মুখে এসে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইলিয়ার। এক ফার গাছের নিচে একা দাঁড়িয়ে ছিল ও।
আয়ত চোখের গভীরে যেন এক অজানা স্বপ্নের ঘোর। গাঢ় সবুজ টুইডের পোশাক পরা। মাথায় একরাশ বাদামী চুল।
আমার মনে হল যেন আচম্বিতেই এক বনদেবীর আবির্ভাব হয়েছে সামনে। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
মেয়েটিও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। মনে হল কিছু যেন বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলল না।
আমি সহসা সংযত বিনীত কণ্ঠে বললাম, মাপ করবেন, আপনাকে চমকে দেবার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। এখানে আর কেউ যে আছে আমি বুঝতেই পারিনি।
মৃদু হেসে ইলিয়া বলল, না, না, আপনি বৃথাই সঙ্কুচিত হচ্ছেন। চারপাশটা কেমন অদ্ভুত নির্জন, আমি তাই দেখছিলাম।
এই জনপ্ৰাণীহীন পাহাড়ী পরিবেশে কথা বলার মত একজন সঙ্গী পেয়ে ভালই লাগল। বললাম, সত্যিই এখানে কেমন একটা গা-ছমছম ভাব যেন।
পাহাড়ের ওপরের ওই প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এই পরিবেশকে যেন আরও গুরুগম্ভীর করে তুলেছে।
-হ্যাঁ ওই বাড়িটার নাম নাকি টাওয়ার।
আমি মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললাম, হ্যাঁ আমিও শুনেছি।
মেয়েটির ঠোঁটে হাসির আভাস খেলল। বলল, জায়গাটা নাকি নিলামে বিক্রি হবার কথা হচ্ছে।
আমি হেসে বললাম, সেই নিলাম থেকেই তো আমি আসছি।
–তাই বুঝি। আপনিও বুঝি জমিটার ব্যাপারে আগ্রহী।
আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, না না, আমি নিতান্তই একজন সাধারণ ব্যক্তি। ওরকম ভাঙাচোরা বাড়ি আর পতিত জমি কিনে নেবার মত সামর্থ্য আমার নেই।
–জায়গাটা কি বিক্রি হয়ে গেছে?
–না। বাঁধা দামটা ওঠেনি বলে ডাক স্থগিত করা হয়েছে। আপনিও নিশ্চয় এমন একটা জায়গা কিনতে চান না।
–অবশ্যই না।
তবে, সত্যি কথা বলতে জায়গাটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। টাকা থাকলে আমি কিনে নিতাম।
-কিন্তু বাড়িটাতো একটা ধ্বংস্তূপ বিশেষ।
-তা ঠিক। তবে সাবেকী বাড়ি থাকা না থাকা সমান। তার প্রতি আমার কোন মোহ নেই। পরিবেশটা বড়ই মনোরম। এদিকটায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, পাহাড়ের সারি, ও দিকটায় রয়েছে অন্তহীন নীল জলরাশি–
সব মিলিয়ে বড় মোহময়। আসুন দেখবেন। বলে মেয়েটির হাত ধরবার জন্য আমি হাত বাড়ালাম।