প্রাসাদের মালিকও গোড়ার দিকে খরচের জন্য কিছুটা খুঁতখুঁত করলেও বাড়িটা দেখার পর গর্বিত হয়েছিলেন।
সেই প্রাসাদপুরী দেখে আমার মনের সুপ্ত বাসনাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, এমন বাড়িতেই বাস করে সুখ। দশজনকে ডেকে দেখানোর মত।
একদিন হঠাৎ মিঃ স্যানটনিক্স আমাকে বললেন, তোমার জন্যও একটা বাড়ি আমি তৈরি করে দিতে পারি। তুমি কি চাও আমি জানি। কিন্তু এটাই দুর্ভাগ্য যে তুমি ধনীব্যক্তি নও।
তারপর মৃদু হেসে বললেন, তোমার মনের মত বাড়ি তৈরি করবার মত ধনী তুমি কোনদিনই হতে পারবে না।
আমি মৃদু আপত্তি প্রকাশ করে বলেছিলাম, এমন কথা কি কখনো বলা যায়? গরীব হয়ে জন্মালেই যে গরীব হয়েই থাকতে হবে এমন কোন বাঁধা ধরা নিয়ম তো নেই। কার ভাগ্য কখন প্রসন্ন হবে, সেকথা কে বলতে পারে।
স্যানটনিক্স বলেছিলেন, তুমি পারতে পার, কেননা, আমি তোমার কথা শুনেই বুঝতে পারছি উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজ তোমার ভেতরে সুপ্ত আছে।
যেদিন সেটা প্রবলভাবে জেগে উঠবে তুমিও অগাধ বিত্তের অধিকারী হতে পারবে।
আমি হেসে বলেছিলাম, তাহলে কথা থাকল, যেদিন আমি সেই অবস্থায় পৌঁছাতে পারব, সেদিন আমার জন্য একটা বাড়ি তৈরি করার জন্য আপনার কাছেই আমি যাব।
একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে স্যানটনিক্স বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য এটাই যে, তার আগেই আমার দিন ফুরিয়ে আসবে। কতবড় জোর আর বছর দুয়েক, এই সময়ের মধ্যে কটা কাজ আর শেষ করে উঠতে পারব।
একটু থেমে পরে আবার বললেন, সময়ের আগেই অনেককে চলে যেতে হয়, যদিও যৌবনের মধ্যিখানে এসে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে হয় না আমার।
আমি বলেছিলাম, তাহলে তো দেখছি আমাকে অতি দ্রুত একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুরুষ হয়ে উঠতে হচ্ছে। তা না হলে মনের মত বাড়ি আর কপালে জুটবে না।
এরপর মিঃ স্যানটনিক্সের সঙ্গে দেখা হয়নি আর। তবে প্রায়ই তার কথা আমার মনে পড়ে। তিনি আমার মনের গভীরে দাগ কাটতে পেরেছিলেন।
স্যানটনিক্সের সঙ্গে আমার স্বপ্নের মধ্যে অনিবার্য ভাবে এসে হানা দিত জিপসি একরের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে টাওয়ার নামের প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, রহস্যময় জিপসি বুড়ি, তার ছোট্ট ঝুপড়িটি।
আর একটা কথাও বলা দরকার, চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমণকালে যেসব মেয়ের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে, তাদের কথা, আমার দু-চারজন বিশিষ্ট যাত্রীর কথাও মনে পড়ত।
দুর্জ্ঞেয় একটা অনুভূতি আমার মন জুড়ে বসেছিল। কেবলই মনে হয় দুর্লভ কোন বস্তু যেন আমার অপেক্ষায় রয়েছে, আশ্চর্য কোন সৌভাগ্য। যেন অবিশ্বাস্য কিছু আমার জীবনে ঘটবে।
সম্ভবতঃ আমার মনের অবচেতনে কোন মেয়ের কথাই থেকে থাকবে। ঠিক মনের মত একটা মেয়ে।
কিন্তু ভালবাসার স্পর্শ তখনো জীবনে পাইনি। ভালবাসা কি তা-ও জানি না। নারীর শরীর, তার বিশেষ বিশেষ অংশ, খাজখোঁজ–এসবই ছিল বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়। তবে এমন কোন স্বপ্ন বা কল্পনা আমার ছিল না, কোন ডানাকাটা পরীর সঙ্গে পথের কোন মোড়ে আমার সাক্ষাৎ হয়ে যাবে, সেই হবে আমার মনের মত জীবনসঙ্গিনী। দুজন শুধু আমরা দুজনের জন্যেই বেঁচে থাকব।
কিন্তু আমি যদি জানতে পারতাম, স্বপ্নও আকস্মিকভাবে কোন একদিন সত্য হয়ে উঠতে পারে–অবচেতনের সমস্ত সুপ্তবাসনা বাস্তব হয়ে দেখা দিতে পারে, আর যদি জানতে পারতাম তার পরিণতি তাহলে আমি চিরকালের মত দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গিয়ে অব্যাহতি পেতে পারতাম।
কিন্তু নিয়তি তো লঙ্ন করার উপায় নেই।
.
০৩.
নিলামের তারিখটায় হাজির হয়েছিলাম বিচিত্র উপায়ে। আমার সওয়ারী তখন এক প্রৌঢ় দম্পতি।
তাদের চাল-চলন, ব্যবহার কোন কিছুই আমার পছন্দ ছিল না। এমন রূঢ় কথা কখনো আমি শুনিনি। নিজেদের সুখ সুবিধা নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত। অন্যের ব্যাপারে লেশমাত্র ভাবনা চিন্তা নেই।
দেখতেও দুজন ছিলেন অতিমাত্রায় কুৎসিত। তাই গোড়া থেকেই মেজাজ খিঁচড়ে ছিল। কিছুতেই আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
মনের ভাব প্রকাশ করবারও উপায় ছিল না। কেননা আমার সেরা ও ব্যবহারের সঙ্গে কোম্পানির সুনাম ও ব্যবসার প্রশ্ন জড়িত।
বাধ্য হয়েই আমাকে অন্য পথ নিতে হল। কাছাকাছি একটা হোটেল থেকে লণ্ডনে আমার অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, হঠাৎ আমার শরীর খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমার পক্ষে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। কোম্পানি যেন অনুগ্রহ করে অন্য কোন ড্রাইভারকে সত্বর এখানে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে।
আমার যাত্রী দুজনেরও কিছু বলার ছিল না। আমার অসুস্থতার খবর জানিয়ে সহজেই সব কিছু সামলে নেওয়া হল। আমি যথাসময়েই নিলামে হাজির হতে পেরেছিলাম।
আগেই বলেছি ইতিপূর্বে কোন নিলামে উপস্থিত হবার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তাই ভেতরে ভেতরে অজানাকে জানার একটা আগ্রহ ও উত্তেজনা আমার ছিল।
কিন্তু নিলাম আসরে উপস্থিত হয়ে আমাকে পুরোপুরি হতাশ হতে হল। এমন একটা বর্ণহীন নিষ্প্রাণ সমাবেশে আসতে হবে কল্পনাই করতে পারিনি।
আধা অন্ধকার একটা থমথমে হল ঘরে মাত্র জনা ছয়-সাত মানুষ উপস্থিত হয়েছে। নিলামদারের চেহারা ভাবলেশহীন আর কণ্ঠস্বর নিষ্প্রাণ। সম্পত্তিটার একটা বিবরণ দেবার পরেই ডাক শুরু হল।