দ্রুত পায়ে নিয়ে থেমে এলাম। টাওয়ার বিক্রির নোটিশ বোর্ডটা চোখে পড়ল আবার। নিলামের দিনক্ষণ দেখে নিলাম ভাল করে।
এর আগে কোন রকম নিলামের ব্যাপারে আমি উপস্থিত থাকিনি। সে কারণে কোন কৌতূহলও ছিল না।
কিন্তু কি জানি কেন, মনে হল, টাওয়ার নিলামের দিনে উপস্থিত থাকব। অন্ততঃ যারা সম্পত্তিটা কেনার জন্য নিলাম ডাকবে, তাদের তো চেনার সুযোগ পাওয়া যাবে।
.
০২.
যোগাযোগটা দৈবাৎই হল বলা চলে। যেদিন টাওয়ার নিলাম হবে, একটা কাজের যোগাযোগে সেদিনই আমাকে জিপসি একরের কাছাকাছি আসতে হল।
এক প্রৌঢ় দম্পতি লণ্ডন থেকে গাড়িভাড়া করেছিলেন। আমি ছিলাম সেই গাড়ির চালক।
আমার বহু বিচিত্র জীবন কাহিনীর সেটা ছিল এক পর্ব।
বাইশ বছরের জীবনের যেটুকু পথ পাড়ি দিয়েছি তাতে অনেক বিষয়েই প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।
এই সুযোগ অবশ্য করে দিয়েছে আমার অন্তর-প্রকৃতি। কোন কাজেই আমি সুস্থির হতে পারতাম না। তাই দিনের পর দিন একটার পর একটা কাজ পাল্টেছি। আর সে কাজও হরেক রকমের।
কি করিনি আমি–আয়ারল্যাণ্ডে কিছুদিন এক ঘোড়ার আস্তাবলে কাজ করেছিলাম। আবার মাদকদ্রব্য পাচারকারী একটি দলের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলাম। তবে ভাগ্য ভাল, সর্বনাশের পথে বেশিদূর এগুবার আগেই সরে আসতে পেরেছিলাম।
এছাড়া, ফলের বাগানে কাজ করেছি, হোটেলের ওয়েটার হিসেবে ছিলাম, সমুদ্র-সৈকতে লাইফ-গার্ডের কাজও করতে হয়েছে কিছুদিন।
অনেক ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করেছি।
আবার একটা সময় দোরে দোরে ঘুরে বিশ্বকোষ বিক্রি করেছি। বোটানিক্যাল গার্ডেনে গাছপালার তদারকের কাজেও নিযুক্ত হয়েছিলাম।
এমনি নানা ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বিষয়ের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছি।
কাজ পাল্টানো যেন একটা নেশার মত হয়ে গেছে আমার। যত পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজই হোক আমার তাতে আলস্য ছিল না।
আসলে দুনিয়াটাকে দেখতে বুঝতে, জানতে আমার খুব আনন্দ। সববিষয়েই আমার দুরন্ত কৌতূহল। তাই সারাক্ষণই কেবল ছুটে বেড়াচ্ছি।
বর্তমানে আমি গাড়ির চালক। গাড়ির কলকজা, কোন কিছুই আমার অপরিচিত নয়। ভাল মেকানিক হিসেবে পরিচিতও হয়েছি।
এছাড়া চালক হিসেবেও আমি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য।
বর্তমানে অনেকগুলো মূল্যবান বিলাসবহুল গাড়ির আমি চালক। ওকাজে বিশেষ পরিশ্রম নেই বটে, তবে বড্ড একঘেয়ে।
একটা অশান্ত বিক্ষুব্ধ মন আমাকে সেই ছেলেবেলা থেকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। স্কুলের গণ্ডি পেরুবার পর থেকেই আমার জীবন এই কর্মস্রোতে ভেসে চলেছে।
মাঝে মাঝে রেসের মাঠে ঢু মারার অভ্যাসও তৈরি হয়েছিল। সম্প্রতি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে। একটা অনামী ঘোড়ার পেছনে কপাল ঠুকে যাবতীয় সম্বল লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ঘোড়াই বাজি জিতে গেল এই সুবাদে বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ আমার পকেটে এসে গেছে। এখন আমি একজন ধনী ব্যক্তি।
জিপসি একরের কথা আমি ভুলতে পারছি না। সারাক্ষণই যেন কানের কাছে গুঞ্জন করে চলেছে।
ঠিক এরকমটা হয়েছিল স্যানটনিক্সের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনও।
স্যানটনিক্স পেশায় একজন স্থপতি। তার সঙ্গে পরিচিত হবার মত কোন সূত্র আমার ছিল না। বস্তুতঃ স্থপতিদের সঙ্গে যোগাযোগের কোন প্রয়োজনও আমার ছিল না।
সেই সময় আমি এক আন্তর্জাতিক ট্যুরিস্ট কোম্পানিতে সোফারের কাজে নিযুক্ত। দেশ-বিদেশের পয়সাওয়ালা যাত্রীদের নিয়ে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে হয়।
কর্মসূত্রেই আমাকে জার্মানী ও ফ্রান্সে কয়েকবার যেতে হয়েছে। দুই দেশের ভাষাও। মোটামুটি রপ্ত করে নিয়েছিলাম।
পয়সাওয়ালা লোকদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে দেখেছি ব্যক্তিগত জীবনে এরা কেউই সুখী মানুষ নয়।
শারীরিক আর মানসিক রোগে সারাক্ষণই ব্যতিব্যস্ত, বিধ্বস্ত। গরীব মানুষদের নিয়ে তারা কখনো মাথা ঘামায় না।
অথচ অর্থবিত্তের অধিকারী না হয়েও জীবনটা ছিল আমার ভারী মজার, আনন্দময়। শরীর স্বাস্থ্যও বরাবরই ভাল। কোন উৎপাত নেই কোনদিকে।
যৌবনের সেই দিনগুলোতে একটা স্বপ্নেই বিভোর হয়ে আছি, কোন দিন অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা লাভ করব।
একবার এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে নিয়ে বিভারিয়া যেতে হয়েছিল। প্রচুর টাকা খরচ করে ভদ্রলোক সেখানে একটা বাড়ি তৈরি করাচ্ছিলেন। সেই বাড়ির স্থপতি ছিলেন মিঃ স্যানটনিক্স। কাজটা হচ্ছিলও তারই তত্ত্বাবধানে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন কাজটা কতদূর এগোলো দেখার জন্য।
মিঃ স্যানটনিক্সকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি কোন দেশের মানুষ। আমার ধারণা স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান। তবে খুবই যে অসুস্থ তা একপলক দেখেই বোঝা যায়। অবশ্য বয়স বেশি নয়।
অতিশয় ক্ষীণ আর দুর্বল। কিন্তু কথাবার্তায় তার মানসিক দৃঢ়তা আর কাজের অফুরন্ত বিশ্বাস ফুটে বেরয় প্রতিক্ষণে।
এই সুযোগেই আমার আলাপ হয়েছিল মিঃ স্যানটনিক্সের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, আমি সকলের বাড়ি তৈরি করি না। আমাকে দিয়ে বাড়ি তৈরি করাতে হলে অগাধ বিত্ত সম্পদের মালিক হতে হয়। সে কারণে আমি আমার পছন্দমত মক্কেল বেছে নিই।
প্রথম আলাপের পর বিভারিয়াতেই আমাদের পরেও বার কয়েক দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি যে প্রাসাদপুরী তৈরি করেছিলেন, সৌন্দর্যে ও বৈশিষ্ট্যে এককথায় তা ছিল অপূর্ব। সেই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করবার মত শব্দ আমার জানা নেই।