এরপর সব ঘটনাই ঘটে চলল ছক বাঁধা পথ ধরে। পরিকল্পনা মতই জিপসি একরেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ হল ইলিয়ার সঙ্গে।
গ্রেটা তার আগেই ইলিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিল, কিভাবে সে আত্মীয়স্বজনের কঠিন অনুশাসনের বাইরে গিয়ে স্বাধীন জীবন উপভোগ করতে পারে।
সেই পরামর্শ মতই ইলিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার একুশ বছর বয়স হলে, ইংলণ্ডে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে।
নিখুঁতভাবে পরিকল্পনাটা ছকে ছিল গ্রেটা। এবিষয়ে তার মাথা যে খুব ভাল খেলে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সমস্ত খুঁটিনাটি বজায় রেখে এমন একটা পরিপাটি ফন্দি কখনোই আমার মাথায় খেলত না।
তবে নিজের ভূমিকাটুকু নিয়ে আমার কোন উদ্বেগ ছিল না। বিশ্বাস ছিল, সুষ্ঠুভাবেই তা সম্পন্ন করতে পারব।
আমাদের পরিকল্পিত পথেই ইলিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা থেকে পরবর্তী ঘটনাবলী এগিয়ে চলল।
আশপাশের কারোর মনে যাতে আমার ও গ্রেটার সম্পর্কে কোন সন্দেহ উঁকি দিতে না পারে সেজন্য আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, আগাগোড়া আমরা পরস্পরের মধ্যে একটা। রেষারেষির ভাব বজায় রেখে চলব।
রঙ্গমঞ্চে গোটা পরিকল্পনাটাকে বাস্তবায়িত করা খুবই ঝুঁকির কাজ ছিল। কিন্তু আমাদের দুজনের নিপুণ অভিনয় গোটা ব্যাপারটাকে নির্বিঘ্নে উৎরে দিয়েছিল।
ইলিয়া এমনই নরম স্বভাবের মিষ্টি মেয়ে ছিল যে তার সঙ্গে প্রেম করা ছিল খুবই সহজ ব্যাপার। অল্প সময়ের মধ্যেই সে আমাকে ভালবেসে ফেলেছিল।…বলতে বাধা নেই…মাঝে মাঝে আমারও সন্দেহ হয়, আমিও হয়তো ওকে ভালবাসতাম। তার সঙ্গ আমার খুবই ভাল লাগত।
তবে গ্রেটা ছিল আমার হৃদয়েশ্বরী। তার পাশে আমি অপর কাউকেই ভাবতে পারি না। সে ছিল আমার সকল কামনা-বাসনার শরীরী প্রতিমূর্তি।
আমি আজ সর্ব অর্থেই একজন সফল পুরুষ। মনের মত নারী, মনের মত বাড়ি এবং অগাধ বিত্ত-সম্পদ আমার করায়ত্ত। ইলিয়ার এক উইলের দৌলতে আমি এখন আমেরিকার ক্রোড়পতিদের একজন।
এই সবকিছু এসেছে খুব সোজা পথে নয়। কেবল ছাল-চাতুরী নয়, খুনও আমাকে করতে হয়েছে, তবে আজ আমি সাফল্যের চূড়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।
আমেরিকা থেকে ফিরে সেদিন সন্ধ্যায় এমনি অনেক কথাই আমার মনে উদয় হয়েছিল। সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় এটাই ছিল আমাদের দুজনের, গ্রেটার এবং আমার সত্যিকার পরিচয় বা উদ্দেশ্য বাইরের কেউ বিন্দুমাত্রও আঁচ করতে পারেনি। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করাবার মত কোন প্রমাণ কেউ কখনো খুঁজে পাবে না।
এতদিন কিছুটা উদ্বেগ আশঙ্কা যদিও বা মনে ছিল, আজ আর তার লেশমাত্র নেই। বিপদের সব রকম সম্ভাবনাই আজ মুছে গেছে।
এখন আমি আমার চির আকাঙ্ক্ষিত নারীকে বিবাহ করে নিঃশঙ্ক মনে স্বপ্নপুরীর অধিপতি হয়ে ভোগ-বিলাসের জীবনে ভেসে পড়ব। আমাদের জয় নিঃশেষে উপভোগ করব।
.
বাড়ির গেটের সামনে আলো জ্বলছিল। সদরে চাবি ছিল না। জুতোর শব্দে বেশ জানান দিয়েই ভেতরে ঢুকলাম।
লাইব্রেরী ঘর পার হয়ে দেখতে পেলাম পাশের ঘরে জানালার ধারে পরী সেজে দাঁড়িয়ে আছে গ্রেটা। আমার জন্যই সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। তার সেই আগুনজ্বলা রূপ বুকের ভেতরে ঝড় তুলল।
কতদিন তার নীল পদ্মের মত আয়ত চোখে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারিনি, পেলব দেহবল্লরীর সুবিন্যস্ত ভাজ, চড়াই-উৎরাই পেষণসুখে আমাকে আবিষ্ট করেনি।
উন্মত্তের মত ছুটে গিয়ে গ্রেটাকে জড়িয়ে ধরলাম। একটা ঝড় যেন দুজনকে উড়িয়ে নিয়ে এসে ফেলল খাটের ওপরে।
.
অনেকক্ষণ পরে দুজন শান্ত হলাম। পরিতৃপ্তির আবেশ কেটে গেলে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। গ্রেটা কিছু চিঠি আমার দিকে এগিয়ে দিল। মিঃ লিপিনকটের খামটাই আগে বেছে নিলাম।
ভদ্রলোক আমার উপস্থিতিতেই পাঠিয়েছিলেন। কি এমন কথা থাকতে পারে যা তিনি মুখে না জানিয়ে চিঠিতে লিখতে বাধ্য হলেন?
গ্রেটা বলল, আমরা আজ বিজয়ী–সার্থক। বাইরের কোন প্রাণীই কিছু জানতে পারেনি।
দুজনেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে হেসে উঠলাম। দুজনেই চুম্বন বিনিময় করলাম।
গ্রেটা জানতে চাইল, মাইক এই বাড়িতেই কি আমরা বরাবর বাস করব?
-অবশ্যই। সারাজীবন যেই বাড়ির স্বপ্ন দেখেছি, সেখানে বাস করবারই তো ইচ্ছে আমার। কেন, তুমি কি বলছ?
–আমার ইচ্ছে, এখন তো ইচ্ছে মত খরচ করবার মত অর্থের অভাব নেই আমার, পৃথিবীটা মনের সুখ ঘুরে দেখব। খুশিমতো কেনাকাটা করব। পাহাড় জঙ্গল মরুভূমি কোথাও বাদ দেব না
–তবে সবসময়েই আবার এখানেই ফিরে আসব।
গ্রেটা মাথা নেড়ে সায় জানাল। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বুকের মধ্যে যেন একটা অস্বস্তি মোচড় দিয়ে উঠল।
এই রাজকীয় প্রাসাদ, অগাধ বিত্ত–তাতেও সন্তুষ্ট নয় গ্রেটা! আরও কিছু পেতে চায় সে। কিন্তু…কিন্তু তার চাওয়ার কি এখানেই নিবৃত্তি হবে? কিন্তু মানুষের চাওয়ার তো শেষ হয় না–গ্রেটার চাওয়াও যে দিন দিন বেড়ে চলবে।
প্রচণ্ড ক্রোধে মাথার ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠল। তীব্র আক্রোশে হাত পা কাঁপতে শুরু করল। জোর করে মনটাকে অন্যদিকে নেবার চেষ্টা করলাম। এমন কেন হল হঠাৎ?
লিপিনকটের চিঠিটা টেনে নিলাম। খামের ভেতর থেকে বেরুলো পুরনো খবরের কাগজ থেকে কেটে নেওয়া একটা ছবি।
ছবিটা কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না–হ্যামবুর্গের একটা কর্মব্যস্ত পথের দৃশ্য। ক্যামেরামেনের সামনেই ছিল কয়েকজন নরনারী। মুখোমুখি এগিয়ে আসছে তারা। প্রথম দুজনকে আমার চিনতে কষ্ট হল না।