আমার মনে যে গ্রেটার প্রতি দুরন্ত ঘৃণা চাপা রয়েছে তা বোঝবার জন্য ইলিয়ার সামনে সেদিন কপট ঝগড়াও বাধিয়েছিলাম।
গ্রেটার মানসিক গঠনও ছিল আমারই মত। তাই প্রথম দর্শনেই সে আমাকে চিনে নিতে ভুল করেনি। আমারই মত তারও বুক জুড়ে ছিল পৃথিবীটাকে ভোগ করবার অদম্য আকাঙ্ক্ষা।
দুজনের চাওয়া একদিন এক হয়ে গেল। হামবুর্গে প্রথম দর্শনের দিনেই আমি তাকে আমার আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা অকপটে খুলে বলেছিলাম। গ্রেটাও তার কামনা-বাসনা আমার কাছে গোপন করেনি।
তারপর সেই মনে করিয়ে দিয়েছিল, মনোবাসনাকে সার্থক করে তুলতে হলে চাই অর্থ–অপর্যাপ্ত অর্থ।
অর্থের পেছনেই ছুটে চলেছি সেই ছেলেবেলা থেকে। স্কুল ছাড়বার পরদিন থেকেই। বছরের পর বছর অক্লান্ত ভাবে কাজ করে গেছি–কিন্তু আকাঙ্ক্ষা পূরণের কোন সম্ভাবনা দেখতে পাইনি। এভাবেই হয়তো জীবন উপভোগের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবন চলে যেত–জাগতিক কামনা-বাসনা পূরণের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত যদি গ্রেটার সঙ্গে দেখা না হত।
গ্রেটা আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, ইচ্ছানুরূপ অর্থ লাভ করার উপায় তোমার হাতেই আছে। মেয়েদের মন কাড়ার মত সম্পদ যার থাকে তার কি অর্থের অভাব হতে পারে? তুমি দেখছি নিজেকেই নিজে চেন না।
-মেয়েদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে যাব কেন? তারপর গ্রেটাকে দুহাতে বুকে টেনে নিয়ে বলেছি, পৃথিবীতে একটি নারীই কেবল আমার কাম্য–আর সে হচ্ছে তুমি। আমি একান্তভাবেই তোমার–কেবল তোমারই।
আমি জানতাম দুনিয়ার কোথাও না কোথাও আমার স্বপ্নের নায়িকা অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য–তোমাকে আমি ঠিক চিনে নিতে পেরেছি।
গ্রেটা বলেছে, কী আশ্চর্য, তোমাকে দেখার পর আমারও একই কথা মনে হয়েছে।
স্বপ্ন সফল করার সহজ পথ গ্রেটা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, অঢেল বিষয় সম্পত্তি রয়েছে এমন কোন ধনী মহিলাকে বিয়ে করতে হবে।
-তেমন বিত্তবান মেয়ে পাব কোথায় আমি?
গ্রেটা হেসে বলেছিল, যদি চাও, তেমন একজনের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিতে পারি।
–কিন্তু তাতে কতটা লাভ হবে। ধনবতী মহিলাদের স্বামী হওয়াটা কিছু মাত্র সুখের বলে মনে হয় না আমার। সারাজীবন পরমুখাপেক্ষী হয়ে জীবন কাটানো সহ্য হবে না আমার।
বরাবর থাকতে যাবে কেন? মতলব হাসিল করতে হলে কিছুদিনের জন্যে তো থাকতেই হবে। স্ত্রী তো একদিন মারা যেতে পারে-কেউ তো আর চিরজীবী হয়ে পৃথিবীতে জন্মায় না।
এতটা আমি ভাবতে পারিনি। স্তম্ভিত হয়ে গ্রেটার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম।
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে গ্রেটা বলল, কথাটা শুনে তুমি খুব বিচলিত হয়ে পড়লে মনে হচ্ছে
–বিচলিত ঠিক না, তবে
–আমি জানতাম তুমি বিচলিত হবে না। এবং অবিচলিত থেকেই তোমাকে কাজ করে যেতে হবে। একজন আমেরিকান ক্রোড়পতি যুবতীর দেখা শোনা আমি করি। তার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। তার ওপর আমার কিছুটা প্রভাব রয়েছে।
বড় বড় ধনীর দুলাল থাকতে আমাকে সে পছন্দ করতে যাবে কেন? তাকে বিয়ে করার যোগ্যতাও সেই সব ধনী-পুত্রদের আমার চাইতে অনেক বেশি।
-তা ঠিক। তবে তোমার মধ্যে যা আছে তা অনেক পুরুষের মধ্যেই থাকে না। তোমাকে দেখে মেয়েরা সহজেই আকৃষ্ট হবে। একজন মেয়ে হিসেবে আমার তাই ধারণা।
গ্রেটার মুখের স্তুতি শুনে আমি আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলাম।
তাছাড়া, সেই মেয়ে অন্য দশটা মেয়ের মত নয়। সারাক্ষণ তাকে অদ্ভুত এক গণ্ডীবদ্ধ জীবনের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হয়।
বিশেষভাবে বাছাই করে ধনকুবের যুবকদের সঙ্গেই কেবল তাকে মিশতে দেওয়া হয়। তোমার মত পুরুষ দেখার সুযোগ সে কোনদিন পায়নি।
তার প্রকৃতি কিছুটা অন্যরকম। আড়ম্বর কৃত্রিম জীবন সে একদম বরদাস্ত করতে পারে না। সে চায় স্বাভাবিকভাবে অন্য পাঁচজনের সঙ্গে মিশতে, পরিচিত গণ্ডীর বাইরের জগৎটাকে জানতে।
তোমাকে যা করতে হবে তা হলো নিপুণ প্রেমের অভিনয়। তাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে প্রথম দর্শনেই তুমি তার প্রেমে ডুবেছ।
তোমার এই অভিনয়ই তাকে আকৃষ্ট করবে–সে বাইরের জগতের মুক্ত হাওয়ার স্বাদ নিতে চাইবে। এর ফলে গণ্ডীবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত মেয়েটি তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। কেন না, ইতিপূর্বে কোন পুরুষের কাছ থেকে সে ঘনিষ্ঠ প্রেমের আহ্বান পায়নি। তুমিই হবে তার জীবনের প্রথম পুরুষ। …কি পারবে না?
গ্রেটার তুলনা হয় না। নিখুঁত পরিকল্পনাটি সে আমার মাথায় নিপুণভাবে ঢুকিয়ে দিল। আমি দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বললাম, একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু তার আত্মীয়-স্বজন কি ব্যাপারটা মেনে নেবে?
গ্রেটা দৃঢ়কণ্ঠে জানাল, তেমন সুযোগই তারা পাবে না। বিয়ের আগে পর্যন্ত তাদের এব্যাপারে কোনকিছুই জানতে দেওয়া হবে না। বিয়েটা সারতে হবে গোপনে–তারপর সকলে জানতে পারবে।
এরপর পরিকল্পনাটা নিয়ে দুজনে অনেক সময় ধরে আলোচনা করলাম। তারপর কিভাবে এগুতে হবে সেই সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেললাম।
গ্রেটা ছুটিতে এসেছিল। সে আবার যথাসময়ে আমেরিকা ফিরে গেল। তবে চিঠিপত্রে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখল।
ইতিমধ্যে আমিও ফিরে গেলাম আমার জীবনে-রুজিরোজগারের ধান্দায়।
একসময় ঘুরতে ঘুরতে জিপসি একরে উপস্থিত হয়েছিলাম। জায়গাটা খুবই পছন্দ হয়ে গেল। গ্রেটাকে চিঠিতে সে কথা জানালাম।