মেয়েটি যে কর্মনিপুণা তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিদায় নেবার আগে মিঃ লিপিনকট শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, জিপসি একরের ঠিকানায় তোমার নামে ছোট্ট একটা চিঠি পাঠিয়েছি। এয়ার মেলে যাবে–তোমার পৌঁছবার আগেই চিঠি পৌঁছে যাবে।…তোমার সমুদ্রযাত্রা শুভ হোক।
.
০৫.
সুদীর্ঘ সংগ্রামের অবসান হয়েছে। এবার আমি আমার নিজের ঘরে ফিরে চলেছি। সমুদ্র যাত্রার অবসান হলেই আমি আমার প্রার্থিত সাম্রাজ্যে অধিষ্ঠিত হব। আর কোন বাধাবন্ধ নেই।
জাহাজে বিলাসবহুল কেবিনে শুয়ে শুয়ে সমুদ্রের অনন্ত বিস্তারের দিকে চোখ মেলে কেবল ভেবেছি, আমার অন্তহীন চাওয়ার এতদিনে অবসান হল। ছেলেবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখে এসেছি এতদিনে তা সার্থক হল।
ইলিয়ার মুখও বারবার ভেসে উঠল চোখের সামনে। সে যেন অন্য এক জন্মের কাহিনী। জিপসি একরে তার সঙ্গে প্রথম দেখা। রিজেন্ট পার্কের নিভৃত কোণে দেখা সাক্ষাৎ, রেজিস্ট্রারের অফিসে অনাড়ম্বর বিবাহ অনুষ্ঠান, তারপর জিপসি একরে স্থাপত্য কৌশলের নব নিদর্শন নয়নাভিরাম প্রাসাদ নির্মাণ–সবই যেন অতি দ্রুত ঘটে গেল।
কিন্তু ওই প্রাসাদ-ওটা সৃষ্টি হয়েছে একান্ত ভাবেই আমার জন্য। এখন এই প্রাসাদপুরীর মালিক আমি। যা হতে চেয়েছিলাম তাই হয়েছি–সুদীর্ঘ সংগ্রামের পরে।
নিউ ইয়র্ক থেকে যাত্রা করার আগে মেজর ফিলপটকে আমার যাত্রার সংবাদ জানিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এয়ার মেলে। আমার পৌঁছবার আগেই তিনি চিঠি মারফত আমার সবকথা জেনে যাবেন।
একমাত্র মেজরকেই আমার অবস্থাটা বোঝানো সহজ বলে মনে হয়েছে। একদিন সকলেই জানতে পারবে, কিন্তু সহজভাবে নিতে পারবে না। কিন্তু মেজর সকলের মত নন, তিনি খুব কাছে থেকে ইলিয়া ও গ্রেটাকে দেখেছেন। সবই জানেন, আমার বিশ্বাস তিনি সহজভাবেই মেনে নিতে পারবেন।
মেজর বিজ্ঞ ব্যক্তি। গ্রেটার ওপরে ইলিয়ার নির্ভরশীলতার বিষয়টি তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এখন ওই ইলিয়া বিহীন প্রাসাদপুরীতে একা আমাকে জীবন কাটাতে হবে। কিন্তু তা যে কতটা দুরূহ নিশ্চয় তিনি অনুভব করতে পারবেন।
ইলিয়ার বদলে একজন কেউ না হলে, আমাকে সাহায্য করবার কেউ না থাকলে, আমি একা বাঁচব কি করে।
আমার একান্ত বক্তব্য যথাসাধ্য বুঝিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি মেজর ফিলপটকে। আমার বিশ্বাস আমি গুছিয়ে লিখতে পেরেছি।
আমার চিঠির কথাগুলো ছিল এরকম
আমাদের প্রতি আপনার সহৃদয়তার কথা স্মরণে রেখেই কথাটা আপনাকেই প্রথম জানাবার প্রেরণা পেয়েছি। আমার সমস্যাটা একমাত্র আপনিই ভাল করে বুঝতে পারবেন। আমেরিকায় যে কটা দিন কাটিয়েছি, প্রতি মুহূর্তে একটা চিন্তাই ঘুরে ফিরে আমার মনে উদয় হয়েছে, একা একা জিপসি একরে বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে কি করে?
অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করেছি, ফিরে গিয়ে গ্রেটার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখব। ইলিয়ার কথা গ্রেটার কাছে ছাড়া আর কাউকে প্রাণ খুলে বলা সম্ভব নয়। গ্রেটা আমাকে বুঝতে পারবে।
আমার বিশ্বাস গ্রেটা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে না। যদি এই বিয়েটা সম্ভব হয়, তাহলে মনে করতে পারব, বরাবরের মত আমরা তিনজনই একসঙ্গে রয়েছি।…
এয়ার মেলের চিঠি নিশ্চয় মেজর আমার পৌঁছবার দিন কয়েক আগেই পেয়ে যাবেন।
.
আজ আমি একজন সার্থক মানুষ। আমার সমস্ত পরিকল্পনা, সমস্ত কর্মকুশলতা, যা আমি চেয়েছিলাম, সবই আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এখন আমি বিজয়ী পুরুষ। বিজয় অভিযান সম্পূর্ণ করে ফিরে চলেছি আমার গৃহে।
দুটো আকাঙ্ক্ষাই আমার জীবনের সমস্ত স্বপ্নকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। সেই দুটোই আজ আমার করায়ত্ত।
চেয়েছিলাম নিজের জন্য মনের মতো একটা প্রাসাদ। সেই প্রাসাদের কল্পনা বিলাস জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। আর চেয়েছিলাম আশ্চর্য সুন্দর এক নারী-মনে প্রাণে একান্তভাবেই সে হবে আমার।
মনে মনে বিশ্বাস করতাম, দুনিয়ার কোথাও না কোথাও সেই নারী আমার প্রতীক্ষায় রয়েছে, কোন না কোনদিন তার সাক্ষাৎ আমি পাব।
তা স্বপ্নের সেই সঙ্গিনীর সন্ধান একদিন পেয়ে গেলাম। দেখা মাত্রই আমরা অচ্ছেদ্য হৃদয়-বন্ধনে আবদ্ধ হলাম–পরস্পরকে আপন করে নিলাম।
আজ সেই প্রণয়িনীর কাছেই ফিরে চলেছি আমি। জাহাজ থেকে নামার পর থেকে তারই ধ্যানে বিভোর হয়ে আছি।
সন্ধ্যার মুখে মুখে ট্রেন থেকে নামলাম। তারপর অপেক্ষাকৃত নির্জন পথ ধরে হেঁটেই রওনা হলাম বাড়ির দিকে।
আমার আসার খবর জানিয়ে গ্রেটাকে আগেই একটা তার করে দিয়েছিলাম। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি স্বপ্নের প্রাসাদপুরীতে গ্রেটা সেজেগুজে আমারই অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছে।
যেই দিনটির জন্য এতদিন আমরা উভয়ে প্রতীক্ষায় দিন গুনেছি, সেই বহুবাঞ্ছিত দিনটি আজ। এই দিনটির জন্য কী কঠিন পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে হয়েছে আমাদের। নিপুণ অভিনেতার মত অভিনয় করতে হয়েছে আমাদের দুজনকেই। এখন আমার নিজেরই হাসি পাচ্ছে আমার অদ্ভুত ভূমিকার কথা মনে করে। গ্রেটার প্রতি আমার বিরূপ মনোভাব যে কপট, ঘুণাক্ষরেও তা কেউ সন্দেহ করতে পারেনি। সবাই জেনেছে গ্রেটাকে আমি সহ্য করতে পারি না, মনে মনে দারুণ ঘৃণা করি।
আমার আর ইলিয়ার মাঝখানে গ্রেটার উপস্থিতিও যে কোনভাবেই আমার অভিপ্রেত নয় ইলিয়াকেও সেকথা নিপুণভাবে বোঝাতে পেরেছি।