আমি এখানে শিকার শিকারীরা সকলে লোলুপ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছে আর জিব দিয়ে থাবা চাটছে।
মিঃ লিপিনকট আমাকে এক আইনজীবীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। খনি সংক্রান্ত সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করবার পরামর্শানুসারে তার প্রয়োজনীয় দলিলপত্রগুলো ভদ্রলোককে দিয়ে দেখিয়ে নেবার দরকার হয়েছিল।
আইনজীবী ভদ্রলোক আমার পরামর্শদাতার নাম জানতে চাইলেন। আমি স্ট্যানফোর্ড লয়েডের নাম করলাম।
নামটা শুনেই গম্ভীরভাবে তিনি বললেন, আমরা যে ব্যাপারটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা না করে কোন মতামত দেব না মিঃ লয়েডের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তির তা জানা উচিত।
পরে তিনি জানিয়েছিলেন, দলিলের শর্ত যা আছে তাতে মালিকানার ব্যাপারে কোন গণ্ডগোল নেই। এমন পরামর্শও তিনি দিলেন, খনিজসম্পদ বিশিষ্ট ওই জমি এখুনি হস্তান্তর করা অনুচিত। ধরে রাখলে পরে অনেক বেশি দাম পাওয়া যাবে।
এই ঘটনা থেকে আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে নিরীহ হরিণ শিশুর মতই শিকারের জন্য আমার চারদিকে সকলে ভিড় করে আছে।
সকলেই বুঝতে পেরে গেছে বিষয় সম্পত্তির লাভ লোকসানের হিসাব নিকেশের ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ ভাবেই অজ্ঞ।
এদিকে শবানুগমনের অনুষ্ঠান বেশ আড়ম্বরের সঙ্গেই সম্পন্ন হল। নানা রঙের ফুলে স্তূপ জমে গেল সমাধিস্থলে।
এই প্রাণহীন আড়ম্বর কিছুই যে ইলিয়া পছন্দ করত না, আমি তা নিশ্চিত ভাবে জানি। কিন্তু আত্মীয়স্বজনের মনস্তুষ্টির এ ব্যাপার আমাকেও মেনে নিতেই হল।
নিউইয়র্কে পৌঁছবার চারদিনের মাথায় কিংসটন বিশপ গ্রামের খবর এল মেজর ফিলপটের চিঠিতে। পুলিস অনেক অনুসন্ধানের পরে জঙ্গলাকীর্ণ এক পাহাড়ী খাদের মধ্যে থেকে বুড়ি লীর মৃতদেহ উদ্ধার করতে পেরেছে।
বুড়ি ওখানে বেশ কয়েক দিন ধরে মরে পড়েছিল। বুড়ি লীর ঘর অনুসন্ধান করে এক গোপন জায়গা থেকে তিনশোখানা পাউণ্ডের নোটও উদ্ধার হয়েছে।
চিঠির শেষে তিনি আরও একটা খবর জানিয়েছেন। লিখেছেন, তুমি দুঃখ পাবে জেনেও লিখতে হচ্ছে, গতকাল ক্লডিয়া হার্ডক্যাসল এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এক্ষেত্রে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েই দুঃখজনক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
দুসপ্তাহের মধ্যেই পরপর দুজনের একইভাবে আকস্মিক মৃত্যু ঘটল ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে। এমন সংবাদের পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়–এসব কি নিতান্তই আকস্মিক, না অন্য কিছু?
.
রাতারাতি আমি ফকির থেকে বাদশা বনে গেছি। এই কথাটা প্রতি মুহূর্তে আমায় মনে করিয়ে দিয়েছে ইলিয়ার পরিবারের অসংখ্য বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজন। সারাক্ষণই আমার মনে হতো এদের মধ্যে আমি কোন ভিনগ্রহের আগন্তুক। চলাফেরায় কথা বলায় একচুল অসতর্ক হবার উপায় নেই।
কতদিন ছিলাম, এখন আর মনে করতে পারি না। তবে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম যে তাতে সন্দেহ নেই।
যার সুবাদে আমার এখানে আসা–সেই ইলিয়া, একান্ত আমার ইলিয়া আর নেই। কিন্তু তার স্মৃতি এখনো তরতাজা রয়েছে জিপসি একরে। সেখানেই ছুটে যাবার জন্য প্রাণটা আইঢাই করতে লাগল।
কিন্তু যেতে চাইলেই কি আর যাওয়া যায়। আমি এখন আর কেবল সামান্য মাইকেল রজার নই। ইলিয়ার উইলের দৌলতে এখন আমি আমেরিকার অন্যতম ক্রোড়পতি। আমার টাকা অসংখ্য জায়গায় লগ্নি করা, নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে সেই বিশাল অর্থনৈতিক জগৎ। তার দায়দায়িত্বও কম নয়–অন্তত খবরাখবর রাখাটুকুও।
যেদিন ইংলণ্ডে ফিরব তার আগের দিন মিঃ লিপিনকট এলেন। তাকে জানালাম স্ট্যানফোর্ড লয়েডকে আমার বিষয় সম্পত্তির লগ্নি সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে চাই।
কথাটা শুনে মিঃ লিপিনকটের ভ্র কুঞ্চিত হল। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। মুখের রেখায় কোন পরিবর্তন ঘটল না। উদ্বিগ্ন ভাবে জানতে চাইলাম, কাজটা যুক্তিযুক্ত হবে বলে কি আপনি মনে করেন?
–তুমি কি তার সম্পর্কে কোন কারণ খুঁজে পেয়েছ?
বললাম, না। তেমন চেষ্টাও করিনি। আমার একরকম অনুভূতির বশেই মনে হয়েছে ভদ্রলোক সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন।
–হুঁ। লিপিনকট এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। পরে বললেন, তোমার এই অনুভূতির প্রশংসা করতে হয়। তোমার অনুমান যে যথার্থ তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
পরিষ্কারই হয়ে গেল, ইলিয়ার লগ্নি সংক্রান্ত ব্যাপারে স্ট্যানফোর্ড লয়েড দীর্ঘদিন থেকেই যথেষ্ট কারচুপির কর্ম করে চলেছেন।
আমি আর কাল বিলম্ব না করে বিষয় সম্পত্তির দেখাশোনার যাবতীয় দায়দায়িত্ব মিঃ লিপিনকটের হাতে তুলে দিলাম।
মিঃ লিপিনকট আমাকে কথা দিলেন, ইলিয়ার সম্পত্তির স্বার্থরক্ষার চেষ্টা তিনি করবেন।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সইসাবুদ হয়ে যাবার পর আমার এদিককার কাজকর্ম আপাততঃ সাঙ্গ হল। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
মিঃ লিপিনকট জানতে চাইলেন, তুমি কি প্লেনে ফিরছ?
–না। জাহাজেই যাচ্ছি। সমুদ্রযাত্রায় খানিকটা মনের সুস্থিরতা ফিরে পাব বলেই আমার বিশ্বাস।
–ফিরে গিয়ে কোথায় উঠছ?
–কেন, জিপসি একরে।
–তাহলে ওখানেই থেকে যাবে সিদ্ধান্ত করেছ?
–হ্যাঁ। জিপসি একর ছেড়ে আমি কোন দিনই যেতে পারব না। তাছাড়া ওখানে গ্রেটা রয়েছে, তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। ইলিয়ার জন্য যথেষ্ট করেছে।
-হ্যাঁ, সেকথা তুমি বলতে পার।
–গ্রেটা সম্পর্কে আমার ভুল ধারণা ভেঙ্গেছে। বাইরে থেকে দেখে তাকে ঠিক বোঝা যায় না। ইলিয়ার মৃত্যুর পর ও যেভাবে আমাকে সাহায্য করেছে, সে বিষয়ে বাইরের কারুরই ধারণা করা সম্ভব নয়। বুঝতেই পারছেন, সঙ্গতভাবেই তার প্রতি আমার একটা কর্তব্যও বর্তেছে।