সব দেখেশুনে আমার মনে হতে লাগল আমি যেন চারপাশে শ্বাপদ বেষ্টিত হয়ে পড়েছি। যে কোন মুহূর্তে এরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।
লিপিনকট আমার মনের কথাটাই যেন উচ্চারণ করলেন, এই পৃথিবীটা খুব একটা ভাল জায়গা নয় মোটেও।
আমি জানতে চাইলাম, ইলিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর ফলে আমি ছাড়া আর কেউ কি লাভবান হচ্ছে?
লিপিনকট আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন তোমার মনে উদয় হল কেন বলতো?
বললাম, কোন কারণ নেই। হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হল, তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম।
লিপিনকট কয়েকমুহূর্ত কি ভাবলেন। তারপর বললেন, ইলিয়া তার উইলে অনেককেই অনেক কিছু দিয়ে গেছে। মিস অ্যাণ্ডারসনের কথাও সে ভোলেনি। তবে তার সঙ্গে যে দেনাপাওনার ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেছিল বেশ মোটা অঙ্কের চেকের মাধ্যমে, তা তুমি হয়তো জানো।
-হ্যাঁ, ইলিয়া নিজেই আমাকে বলেছে।
–ইলিয়ার নিকট আত্মীয় বলতে একমাত্র তুমিই নিশ্চয় আমাকে একথা বলতে চাওনি?
–আমি কিছু বোঝাবার চেষ্টা করিনি। কিন্তু মিঃ লিপিনকট, আপনিই কিন্তু আমার মনটাকে সন্দেহপ্রবণ করে তুলছেন। কাকে সন্দেহ করব, কেন সন্দেহ করব না, এসব কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।
–সেটাই স্বাভাবিক। তবে কারুর মৃত্যু ঘটলে, সেই মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একটা হিসেব নিকেশের প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ব্যাপারটার নিষ্পত্তি যে সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায় এমন নয়, অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে তার জের চলতে থাকে।
–আপনি কি ইলিয়ার মৃত্যু সম্পর্কে ইঙ্গিত করতে চাইছেন? এব্যাপারেও কি কোন অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন?
-না তেমন কোন আশঙ্কা আমি করছি না। তবে ইলিয়ার অকাল মৃত্যুর বিষয়ে কারুর মনে প্রশ্ন জাগাটাও অস্বাভাবিক নয়।
ইলিয়ার মৃত্যুতে কেউ না কেউ তো নিশ্চয় লাভবান হবে। এখন সে যদি খুবই সাধারণ কেউ হয় তাহলে তার দিকে সহজে কারুর নজরে পড়বে না। সেক্ষেত্রে নিজের অপকর্মের চিহ্ন প্রমাণ খুব সহজেই সে লোপাট করে দেবার সুযোগ পাবে।
একটু থেমে পরে বললেন, তুমি তোমার নিজের কথাই এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে ধরতে পার। তবে এ বিষয়ে আর কোনরকম আলোচনা না করাই আমার পক্ষে বাঞ্ছনীয়। নিরপেক্ষতা রক্ষা করা আমার কর্তব্য।
ইলিয়ার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হয়েছিল খুবই সাধারণভাবে স্থানীয় একটা গীর্জায়। আমার দুরে সরে থাকবার উপায় ছিল না।
গীর্জার বাইরে যারা সমবেত হয়েছিল, তাদের অনেকেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। গ্রেটাই আমাকে সারাক্ষণ আগলে রাখল। তার ব্যবস্থাপনাতেই সমস্ত ব্যাপারটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হল।
এখানকার সমস্ত কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে গ্রেটাকে আমি নতুন ভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পেলাম। তার মত করিৎকর্মা মেয়ে খুব কমই আমার চোখে পড়েছে। বুঝতে পারছি এই কারণেই ইলিয়া তার ওপরে এমন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
গীর্জায় উপস্থিত হয়েছিল আমাদের প্রতিবেশীদের প্রায় সকলেই। সকলকে আমি চিনি না। তবে একজনকে দেখে মুখটা খুব পরিচিত বলে মনে হল। তবে কোথায় দেখেছি স্মরণে আনতে পারলাম না।
একসময় ক্লান্ত অবসন্ন মনে বাড়িতে ফিরে এলাম। একটু পরেই পরিচারক কার্সন এসে জানাল আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য কে একজন বৈঠকখানা ঘরে বসে আছে।
খুবই বিরক্ত হলাম। বললাম, আজ কারুর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয় জানিয়ে দাও। আর অচেনা কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া তোমার উচিত হয়নি।
কার্সন সবিনয়ে জানাল, ভদ্রলোক নাকি বলেছেন তিনি আমার আত্মীয়। একটা কার্ড আমার হাতে দিল। উইলিয়াম আর পার্ডো-নামটা কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। এরকম নামের কাউকে চিনি বলেও মনে হল না। অগত্যা কার্ডটা গ্রেটাকে দিলাম।
গ্রেটা একপলক দেখেই চিনতে পারল। বলল, হ্যাঁ, ভদ্রলোককে চিনি। ইলিয়ার জ্ঞাতিভাই। ইলিয়া তাকে রুবেন কাকা বলে ডাকতো।
এতক্ষণে মনে পড়ল, গীর্জায় সমবেত লোকজনের মধ্যে কেন একজনকে আমার চেনা মনে হয়েছিল। ইলিয়ার বসার ঘরে তার আত্মীয় পরিজনের একটা গ্রুপ ফোটো টাঙানো ছিল। মিঃ পার্ডোর ছবিও ছিল তার মধ্যে।
বাধ্য হয়েই খবর পাঠিয়ে দিয়ে মিনিট দুয়েক পরে আমাকে বৈঠকখানা ঘরে উপস্থিত হতে হল। মিঃ প্রার্ডো উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে সুপ্রভাত জানালেন।
-তুমি নিশ্চয় মাইকেল রজার। আমি হচ্ছি ইলিয়ার জ্ঞাতিভাই। বয়সে অনেক বড় বলে ও আমাকে রুবেনকাকা বলে ডাকত। আমার কথা নিশ্চয় তুমি ইলিয়ার মুখে শুনে থাকবে। এই প্রথম আমাদের চাক্ষুষ পরিচয় হল।
-সাক্ষাৎ না হলেও আপনাকে চিনতে অসুবিধে হয়নি আমার।
–এমন অকালে ইলিয়াকে আমরা হারাব স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। কতটা যে আঘাত লেগেছে আমার তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ।
আমি ধীরে ধীরে বললাম, আপাতত এই প্রসঙ্গ না উঠলেই আমি স্বস্তি পাব।
–হ্যাঁ, আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারি।
ভদ্রলোক আরো কি বলতে যাচ্ছিলেন, বাধা পড়ল কফির সরঞ্জাম নিয়ে গ্রেটা ঘরে ঢোকায়। আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তনের সুযোগ পেলাম।
–মিস অ্যাণ্ডারসনের সঙ্গে নিশ্চয় আপনার পরিচয় আছে?
নিশ্চয়ই। গ্রেটার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কেমন আছো গ্রেটা?