–নোটিশ দেখলাম, জায়গাটা নিলামে বিক্রি হবে।
–তাই বুঝি। তা হোক, কিন্তু সম্পত্তিটা যে কিনবে তার সর্বনাশ হবে নির্ঘাৎ।
–এতবড় জমি কারা কিনবে কিছু শুনেছ?
–জমিটা কেনার কথা মাত্র জনাকয়েকের মাথাতেই ঘুরছে। দাম তত বেশি উঠবে না, সবাই জানে অভিশপ্ত জমি। খুব কমদামেই তাই বিক্রি হয়ে যাবে।
সস্তায় পেলে কোন একজন ধনী ব্যক্তিই হয়তো কিনে নেবে। কিন্তু এখানে এসে কি করবে?
কথাটা শুনে বুড়ি কেমন খলখল শব্দে হেসে উঠল। অজানা আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর ছমছম করে উঠল।
বুড়ি বলল, কেন পুরনো প্রাসাদ ভেঙ্গে নতুন সব ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবে। তারপর সেগুলো হয় ভাড়া দেবে নয় তো বিক্রি করবে।
বলতে বলতে বুড়ি আবার সেই মারাত্মক হাসি হেসে উঠল। হাসি থামলে কেমন তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, অভিশপ্ত মাটিতে সবকটা বাড়িই হবে অভিশপ্ত। সুখে বাস করা কারোর ভাগ্যে হবে না।
বুড়ির প্রথম কথাটাই কানে লেগেছিল। তাই বললাম, অতীতের এমন একটা বনেদী বাড়ি ভেঙ্গে ফেলাটা কোন কাজ নয়।
-শোনহে ছোকরা, এ জমি কিনে ক্ষতি ছাড়া কারুর লাভ হবে না। এখানে কাজ করবার জন্য যেসব শ্রমিক মজুর আসবে, তাদের অনেকেই দুর্ঘটনায় মারা পড়বে। তারপর থেকে নানান রকমের দুর্ঘটনা লেগেই থাকবে।
আমি লক্ষ করছিলাম, বুড়ি কেমন জোরের সঙ্গেই কথাগুলো বলছে। কেমন দুর্বোধ্য ঠেকছিস আমার।
বুড়ি নিজের মনেই বলে চলল, এটা হল জিপসি একর–পুরো তল্লাট অভিশপ্ত। এখানে কারুর কখনো ভাল হতে পারে না।
শেষ কথাগুলো বুড়ি এমন ভাবে বলল যে আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম।
-না বাছা, বুড়ির সারামুখে এখন রাগ গমগম করছে, অমন দাঁত দেখিয়ে হেসো না। আমি দেখতে পাচ্ছি, ওই হাসি একদিন চোখ ভরা কান্না হয়ে ঝরবে।
এখনো বলছি, আখেরে ভাল চাও তো এই অঞ্চলের বিষ নিঃশ্বাস গায়ে লাগবার আগে পালিয়ে যাও।
–কিন্তু, তুমি তো জানবে নিশ্চয়ই অমন বাড়িটার এই ভগ্নদশা হল কেন? বর্তমান মালিক কোথায় থাকে?
–বর্তমান মালিক? অতশত বলতে পারব না। কিন্তু শুনে রাখ যারা এখানে বাস করবে বলে এসেছিল তারা আর একজনও বেঁচে নেই। ভূত হয়ে গেছে।
-তারা মারা গেছে কিভাবে?
রহস্যময় হাসি হেসে বুড়ি লী বলল, সে সব পুরনো কথা আর বলতে চাই না। শুধু এটুকু শুনে রাখ, তারপর আর কেউ এখানে থাকতে আসেনি। অতবড় বাড়ি খালি পড়ে থেকে এখন একটা ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাচ্ছে। মালিকরা আর এই বাড়ির কথা মনে করতে চায় না। অবশ্য সেটাই মঙ্গল।
–কিন্তু পুরনো সেই ইতিবৃত্ত তুমি আমাকে বলতে পারতে। সবইতো জান তুমি।
–না বাছা জানলেও ওসব নিয়ে কারো কাছে গল্প করি না।
বলে বুড়ি হঠাৎই থেমে গেল। আমার দিকে দু-পা এগিয়ে এল। আমার মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিনতিভরা গলায় বলল, তবে, তুমি যদি জানতে চাও, তোমার ভাগ্য আমি বলে দিতে পারব। তার জন্য আমাকে একটা রুপোর মুদ্রা দিলেই হবে, বেশি দিতে হবে না।
বুড়ির আগেকার কণ্ঠস্বর যেন সম্পূর্ণ পাল্টে গেল।
গলার খসখসে ভাবটা অদ্ভুত রকমের মোলায়েম করে সে বলতে লাগল, তোমার হাতের রেখা দেখেই ভবিষ্যতের ভালমন্দ সবকথা আমি বলে দিতে পারব। তোমার সুন্দর কপাল দেখেই বুঝতে পারছি ভবিষ্যতে অনেক উন্নতি করবে তুমি।
আমি হেসে বললাম, তোমাদের জিপসিদের ওসব বুজরুকি আমি একদম বিশ্বাস করি না। তাছাড়া দানখয়রাত করার মত মুদ্ৰাটুদ্রাও আমার কাছে নেই।
বেশ তো, আধ শিলিংই না হয় দিও। তুমি ভাগ্যবান যুবক, এ আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
অগত্যা একটা ছ পেনীর মুদ্রা বুড়ির হাতে দিতে হল। ওর চোখের লোলুপ দৃষ্টি কেমন ঝকঝক করে উঠল। ফোকলা দাঁতে অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে বলল, তোমার দু হাতের মুঠো আমার সামনে মেলে ধর।
আমি হাত মেলে ধরলাম। বুড়ি তার শীর্ণ থাবার মধ্যে টেনে নিয়ে রেখাগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে কি দেখল। তারপর আচমকা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল। নিজেও দু পা পিছিয়ে গেল। তার ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি অসম্ভব ধারালো হয়ে উঠল।
চিলের মত কর্কশ কণ্ঠে সে বলে উঠল, পালাও পালিয়ে যাও এখান থেকে। যদি নিজের মঙ্গল চাও তো কোনদিন আর জিপসি একরে পা দিও না। নাম পর্যন্ত মুখে আনবে না।
-কেন, ওকথা বলছ কেন?
–এখানে তোমার জন্য কেবল চরম দুঃখকষ্টই অপেক্ষা করে আছে। একদম খাঁটি কথা বলছি, মারাত্মক কোন বিপদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এখান থেকে আমাকে তাড়াবার ব্যস্ততা দেখে হেসে ফেললাম। বললাম, এত লোক থাকতে শেষে আমার জন্যই বেছে বেছে বিপদগুলি সব…
বুড়ি আমাকে কথা শেষ করতে দিল না। দ্রুত পায়ে তার ঝুপড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।
বুড়ির ভাবসাব দেখে মনে হল যেন আমাকে এখান থেকে সে তাড়াতে পারলে বাঁচে। হয়তো দক্ষিণাটা মনমতো হয়নি বলেই এমন ব্যবহার।
হাত দেখা, ভবিষ্যৎ গণনা–এসবে কোন কালেই আমার বিশ্বাস নেই। তবে জীবনের পথে নানা উত্থানপতনের মধ্যে দিয়ে চলে ভাগ্যকে অবিশ্বাস করি না।
ইতিমধ্যে সূর্য অস্ত গেছে। চারপাশে রহস্যময় অন্ধকার নেমে আসছে। হাওয়ার বেগও সুবিধার মনে হল না। গাছপালা দুলতে শুরু করেছে প্রবল ভাবে। আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।