.
০৩.
আমাদের ধারণা ছিল ইলিয়ার আত্মীয় স্বজন সকলেই আমেরিকা ফিরে গেছে। কিন্তু পরে অবাক হয়ে জানলাম, তারা প্রায় সকলেই বর্তমানে ইংলণ্ডে উপস্থিত।
মিসেস কোরা অবশ্য এমনিতেই সর্বক্ষণ চরকির মত দুনিয়ার সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার কথা আলাদা।
তবুও চমৎকৃত না হয়ে পারলাম না যখন শুনতে পেলাম, ইলিয়ার মৃত্যুর দিন কোরা এই পাহাড়ী গ্রামের পাশেই ছিল। ঘটনার মাত্র দুদিন আগে সে লণ্ডনে এসে পৌচেছে।
কোরার সঙ্গে একই প্লেনে স্ট্যানফোর্ড লয়েডও ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে আমেরিকা থেকে লণ্ডনে হাজির হয়েছে। এরা দুজনেই দুঃসংবাদটা জানতে পারে দৈনিক সংবাদপত্রের সান্ধ্য সংস্করণের খবর পড়ার পরে।
যাই হোক, একটা বিরাট হৈ চৈ, আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যেতে হয়েছিল আমাকে। সাংবাদিকরা ঝাঁক বেঁধে এসে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে, সাক্ষাৎকার চাইছে। ওদিকে বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য চিঠি আসছে, তার আসছে, দর্শনার্থীর সংখ্যাও নগণ্য নয়।
অবাক হলাম দেখে গ্রেটা একা হাতেই আশ্চর্য নিপুণতায় সবদিক সামাল দিচ্ছে। আমাকে খুব একটা বিব্রত হতে হয়নি।
একটা বিশ্রী অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল, ইলিয়াকে কোথায় সমাহিত করা হবে সেই ব্যাপার নিয়ে। আমার ধারণা ছিল জিপসি একরেই তার অন্তিম শয়নের ব্যবস্থা করা হবে। কেন না, এই জায়গাটাকে ভালবেসে আমরা দুজনেই এখানে বাস করতে এসেছিলাম।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ইলিয়ার আত্মীয়স্বজন ইলিয়ার মৃতদেহ আমেরিকায় নিয়ে যাবারই পক্ষপাতী। তার পূর্বপুরুষদের যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে তারও সমাধি রচনা করা হবে।
আপত্তি করার বিশেষ কারণ ছিল না বলে আমি এ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার দায়িত্ব আত্মীয় স্বজনের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম।
ইলিয়ার এনড্রুকাকা অর্থাৎ মিঃ লিপিনকট একসময় আমাকে জানিয়েছিলেন, ব্যবসা সংক্রান্ত জরুরী কিছু কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য আমাকেও এই সময় একবার আমেরিকা যেতে হবে।
এসব ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকতো না। তাই কখনো মাথা ঘামাবার চেষ্টা করতাম না। ইলিয়া নিজেই সব সামলাত। তাই বললাম, ওসব ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো কোনকালে ছিল না।
লিপিনকট বললেন, আগে না থাকলেও এখন বর্তেছে। তুমি নিশ্চয়ই জান, ইলিয়ার যাবতীয় বিষয়সম্পত্তির তুমিই এখন একমাত্র উত্তরাধিকারী। ইলিয়া সেরকমই উইল করে গেছে।
–এরকম কোন উইল যে ইলিয়া করেছে তা আমি জানি না।
লিপিনকট বললেন, হ্যাঁ সে উইল করে গেছে। তোমাদের বিয়ের কিছুদিন পরেই পাকা বৈষয়িক মানুষের মত সে একটা উইল করে।
লণ্ডনের আইনজীবীদের কাছে সে উইলটা জমা রাখা আছে। ইলিয়ার ইচ্ছানুসারেই উইলের একটা কপি আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আমি লিপিনকটের মুখের দিকে তাকালাম। এই ঝানু আইনজ্ঞ লোকটিকে আমার ভীষণ ভয়। সবসময় তার সব কথার অর্থ বুঝে ওঠা যায় না। মুখ দেখে ভদ্রলোকের মনোভাব আঁচ করা দুঃসাধ্য।
লিপিনকট সামান্য ইতস্তত করে বললেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তোমার একবার আমেরিকা যাওয়া প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি। বিষয় সম্পত্তি এখন তোমার, এসব দেখাশোনার দায়দায়িত্ব তুমি তোমার পছন্দমত সেখানকার কোন আইনজ্ঞের হাতে তুলে দিয়ে আসতে পার।
–তার কি প্রয়োজন?
কারণ, বিশাল সম্পত্তির দায়দায়িত্ব কিছু কম নয়। সবকিছু ঠিকভাবে তদারকি করতে হলে তোমাকে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ মেনেই চলতে হবে।
কিন্তু এসব তো আমি কিছুই বুঝি না। অকপটে স্বীকার করলাম আমি।
সহানুভূতির সুরে লিপিনকট শান্তভাবে বললেন, তোমার অবস্থাটা আমি উপলব্ধি করতে পারছি।
–ইলিয়ার বর্তমানে যেমন ছিল, এখনও তো আপনিই সমস্ত কিছুর তত্ত্বাবধান করতে পারেন।
–তা অবশ্য পারি। –
-তাহলে অন্য কাউকে এর মধ্যে জড়াতে যাব কেন?
-বলছি একারণে যে, ইলিয়ার পরিবারের আরো কয়েকজনের দায়িত্ব ইতিপূর্বেই আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছে। তাদের স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে তা আমার দেখা কর্তব্য। অবশ্য তুমি যদি আমাকেই দায়িত্ব দিতে চাও তাহলে তোমার স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যবস্থাও আমাকে যথাযথ ভাবে করতে হবে।
আমি লিপিনকটকে বারবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বললাম, আপনি সত্যিই দয়ালু।
–তাহলে তোমাকে কয়েকটা পরামর্শ আমার এখুনি দেওয়া উচিত।
আমি সবিনয়ে বললাম, বলুন।
–সইসাবুদের ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকবে। বিশেষত ব্যবসা সংক্রান্ত কোন নথিপত্রে। ভাল করে খুঁটিয়ে না দেখে কোথাও কোন সই করবে না।
কিন্তু এসব বৈষয়িক নথিপত্র কি একবার দুবার পড়েই আমি বুঝতে পারব?
-বুঝতে কোথাও অসুবিধা বোধ করলে, সই করবার আগে তোমার আইনজ্ঞের পরামর্শ নেবে।
আমি কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, বিশেষ কারুর সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার উদ্দেশ্যেই কি আপনি আমাকে এই কথা বলছেন?
–তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান বলেই আমি মনে করি, আমার কথা বুঝতে পারবে। তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে যুক্তিযুক্ত নয়।
তবে এটুকু বলতে পারি, যেখানে অর্থকড়ির প্রশ্ন জড়িত, সেখানে কাউকেই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা উচিত নয়।
লিপিনকট নির্দিষ্ট করে কোন ব্যক্তির নাম না করলেও তিনি যে বিশেষ কোন ব্যক্তি সম্পর্কে আমাকে সতর্ক করে দিতে চাইছেন, তা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। সেই বিশেষ ব্যক্তিটি কোরা কিংবা স্ট্যানফোর্ড অথবা ইলিয়ার ফ্রাঙ্কপিসে হওয়াও বিচিত্র নয়–আমি চিন্তা করলাম।