–শুনেছি, এক আমেরিকান ভদ্রলোকের সঙ্গে ক্লডিয়ার বিয়ে হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম মিঃ লয়েড।
মিঃ স্ট্যানফোর্ড লয়েড নামে আমার স্ত্রীর এক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। অবশ্য দুই লয়েড যে একই ব্যক্তি আমি সেই কথা বলছি না। লয়েড নাম দুনিয়ায় অনেকেরই থাকা সম্ভব।
আর তা যদি হয়ও, আপনার উল্লেখিত দুই লয়েড একই ব্যক্তি, তাতেই বা কি এসে যায়?
–আমার একটা সন্দেহের কথা আপনাকে জানাচ্ছি। ওই দুর্ঘটনার দিন আমার মনে হচ্ছে যে মিঃ স্ট্যানফোর্ড লয়েডকে বাটিংটনের জর্জ হোটেলে লাঞ্চ খেতে দেখেছি।
–অথচ সেদিন তিনি আপনাদের ওখানে যাননি?
–না। তাছাড়া মিঃ লয়েডের গাড়িতে সেদিন এক মহিলাকেও চোখে পড়েছিল। ক্লডিয়ার চেহারার অনেকটাই মিল আছে সেই মহিলার সঙ্গে। অবশ্য আমি দেখেছিলাম রাস্তার অপর ধার থেকে–আমার চোখের ভুলও হতে পারে। তবে আমাদের এই নতুন বাড়িটা যিনি তৈরি করেছেন তিনি ছিলেন ক্লডিয়ারই এক জ্ঞাতিভাই।
সার্জেন্ট কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। পরে বললেন, আচ্ছা, আপনাদের বাড়িটার ওপরে ক্লডিয়ার বিশেষ আগ্রহ আছে, এমন কি কখনো মনে হয়েছে আপনার?
-না-না–তা কেন। ক্লডিয়া তার দাদার তৈরি কোন বাড়িই সুনজরে দেখে না।
এরপর আরো দু-চারটে কথা বলে আমি সার্জেন্টের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। চলে আসার আগে বুড়ি লীর সন্ধান পেলে আমাকে জানাতে অনুরোধ করে এলাম।
থানা থেকে বেরিয়ে এসেই দৈবাৎই দেখা হয়ে গেল ক্লডিয়া হার্ডক্যাসলের সঙ্গে। একেবারে মুখোমুখি।
ক্লডিয়া সবে পোস্ট অফিস থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। সদ্য সদ্য আমি তার সম্পর্কেই সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলে এসেছি। তখনো পর্যন্ত চিন্তার রেশ মন থেকে মুছে যায়নি।
এই অবস্থায় অভাবিতভাবে চোখের সামনে তাকে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে গেলাম। ক্লডিয়াও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার চোখে মুখে কেমন বিব্রত, কুণ্ঠিত ভাব।
ইলিয়ার ব্যাপারটা একেবারেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না মাইক। ওই পরিণতি যে এমন মর্মান্তিক হবে–বুঝতে পারছি এই বেদনাদায়ক বিষয়টা এখন উত্থাপন করা খুবই অস্বস্তিকর, তবু না বলে তো পারছি না ।
–সবই বুঝতে পারি ক্লডিয়া। এই নির্জন গ্রামে তুমিই ছিলে তার একমাত্র বন্ধু। তুমি তাকে এমন আপন করে নিয়েছিলে যে গ্রামটাকে সে সহজেই নিজের বলে মনে করতে পেরেছিল। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
ক্লডিয়া এর পরে ঘনিষ্ঠভঙ্গিতে বলল, তোমার সঙ্গে একটা ব্যাপারে কথা বলব ভেবেছিলাম।
আমি আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, অসুবিধা কি আছে–স্বচ্ছন্দে বলতে পার।
-শুনলাম তুমি নাকি শিগগিরই আমেরিকা যাচ্ছ?
–হ্যাঁ। খুব শিগগিরই একবার যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তোমার কথা…
-হ্যাঁ বলছি। তুমি যদি এই বাড়িটা বিক্রি করে দেবার কথা চিন্তা করে থাকো, তাহলে তোমার আমেরিকা রওনা হবার আগেই এ বিষয়ে কথাবার্তা বলা যেতে পারে।
স্তম্ভিত আহত দৃষ্টিতে ক্লডিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমন একটা প্রস্তাব ওর মত মেয়ের কাছ থেকে আসতে পারে, এ আমার কল্পনাতেও ছিল না।
সংযত কণ্ঠে বললাম, বাড়িটা তুমি কিনতে চাও? কিন্তু আমি তো জানতাম এ ধরনের আধুনিক বাড়িঘর তোমার অপছন্দ।
–হ্যাঁ, কথাটা আমি বলেছিলাম বটে। কিন্তু দাদা রুডলফের মুখে শুনেছি, ওটাই নাকি তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি।
বাড়িটার জন্য যে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে তা আমি আন্দাজ করতে পারি। সব দিক ভাবনাচিন্তা করেই কথাটা তোমাকে বললাম।
ব্যাপারটা কেবল অস্বস্তিকর নয় অস্বাভাবিকও মনে হল আমার। ইতিপূর্বে অনেকবারই ক্লডিয়া আমাদের বাড়িতে গেছে। তার কথাবার্তা হাবভাবে কখনো প্রকাশ পায়নি, বাড়িটার প্রতি তার কোন বিশেষ আকর্ষণ আছে।
তাছাড়া ক্লডিয়ার দাদা স্যানটনিক্সের শিল্পীসত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবশত বাড়িটার প্রতি যে সে আকর্ষণ বোধ করবে তেমনও নয়। স্যানটনিক্স সম্পর্কে যে সব মন্তব্য সে করেছে তাতে তার প্রতি বিরূপ মনোভাবই বরাবর প্রকাশ পেয়েছে। কি জানি হয়তো আমার ধারণায় ভুল ছিল।
আমি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললাম, আমি যে বাড়িটা বিক্রি করতে চাই এমন ধারণা তোমার হল কি করে ক্লডিয়া? এ জায়গাটা ইলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত। এ জায়গা ছেড়ে আমি অন্য কোথাও যাব না।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক ঠেলে। পরে আবার বললাম, জিপসি একরকে আমরা দুজনেই ভালবেসেছিলাম, এখানে বাস করব বলে এসেছিলাম।
তার স্মৃতি বুকে আঁকড়ে আমি এখানেই পড়ে থাকতে চাই। জায়গা বিক্রি করার কথা যেন ভুলেও আমার মনে উদয় না হয়।
ক্লডিয়া নীরবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আমারও আর কোন কথা বলার প্রবৃত্তি হল না।
কিন্তু হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই আমাকে কথা বলার শক্তি সঞ্চয় করতে হল।
ধীরে ধীরে বললাম, কিন্তু যদি মনে কর, একটা প্রশ্ন করব। নেহাৎই ব্যক্তিগত প্রশ্ন, জবাব দেওয়া না দেওয়া তোমার ইচ্ছা।
ক্লডিয়া গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে আমার দিকে তাকাল। বললাম, তোমার সঙ্গে যে আমেরিকান ভদ্রলোকের বিবাহ হয়েছিল তার নাম কি স্ট্যানফোর্ড লয়েড?
নির্বাক ক্লডিয়া কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য আঁচ করবার চেষ্টা করল সম্ভবত পরে হঠাৎই হ্যাঁ, বলে মাথা নেড়ে ধীর পায়ে আমার সামনে থেকে সরে গেল। আমাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করবার সুযোগ দিল না।