আচ্ছা, বিয়ের আগে তোমার স্ত্রী কখনো এই অঞ্চলে বাস করতে এসেছিল কিনা সে সম্পর্কে তোমার কিছু জানা আছে?
মেজরের প্রশ্নটা শুনে আমি অকস্মাৎ অদ্ভুতভাবে অট্টহাস্য করে উঠলাম। সেই হাসি আমাকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছিল। সাময়িকভাবে আমি যেন আমার ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আমার এই অস্বাভাবিক আচরণেও মেজরের প্রশান্ত মুখে কোন ভাবান্তর ঘটেনি। তিনি ছিলেন যথার্থই দয়ালু ব্যক্তি। সহৃদয়তার সঙ্গেই আমাকে বিবেচনা করছিলেন।
সামলে ওঠার পরে আমি মেজরকে বললাম, এই জিপসি একরেই ইলিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল।
নিলামের নোটিশ থেকে টাওয়ার নামের প্রাচীন সৌধটা বিক্রির কথা জানতে পেরেছিলাম। হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম।
জায়গাটা নিজের চোখে দেখার জন্যই একদিন হাঁটতে হাঁটতে জিপসি একরে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম।
একটা ছায়ায় ঢাকা অন্ধকার পথে গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল ইলিয়া–তখনই আমার সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়।
পরে সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠ হলে আমরা জিপসি একরে নিরিবিলি বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করেছিলাম। আমার মত ইলিয়াও সেই প্রথম জিপসি একরে এসেছিল।
–জায়গাটা যে অভিশপ্ত একথা নিশ্চয় তুমি শুনেছিলে? তুমি সেকথা বিশ্বাস করতে?
–শুনেছিলাম, এখানে পা দেবার আগেই। কিন্তু এ সম্পর্কে আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা আমি নিজেই জানি না। তবে ব্যাপারটাকে একটা অন্ধ কুসংস্কার বলে প্রাণপণে বিশ্বাস করবার চেষ্টা করতাম।
আমার মানসিক অবস্থার কথা হয়তো ইলিয়া বুঝতে পেরেছিল। একটা আশঙ্কার ছায়া ওর মনেও রেখাপাত করেছিল।
সেকথা, জানতে পেরে, আমার বিশ্বাস, ইচ্ছাকৃতভাবেই কেউ ওকে আতঙ্কিত করে তোলার চেষ্টা করেছিল।
–কে তাকে ভয় দেখাতে পারে বলে তুমি মনে কর?
–একথা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না। তবে জিপসি বুড়ি মাঝে মাঝেই সুযোগ বুঝে ইলিয়ার পথের ওপরে এসে দাঁড়াত, জিপসি একর ছেড়ে যাবার জন্য তাকে ভয় দেখাত।
মেজর বললেন, তোমার কাছ থেকে এই ঘটনার কথা জানার পর আমি বুড়িকে ডেকে বেশ কড়া করে ধমকেও দিয়েছিলাম।
–কিন্তু বুড়ির এরকম আচরণের পেছনে কারণটা কি হতে পারে, সেসম্পর্কে আপনার ধারণাটা কি?
-দেখ রজার, বুড়িকে আমি খুব ভালভাবে জানি। নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করার একটা ঝোঁক ওর মধ্যে বরাবর কাজ করত। ওর আচার-আচরণের মধ্যে সেই ভাবটা প্রকাশ পেত।
কাউকে অকারণে শঙ্কিত করে তুলে, কাউকে আশার কথা শুনিয়ে, কাউকে ভবিষ্যতের রঙীন স্বপ্নের কথা বলে এমন একটা ভাব প্রমাণ করবার চেষ্টা করত যেন মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ সবই সে পরিষ্কার দেখতে পায়।
–শুনেছি বুড়ি নাকি খুবই অর্থলিলু। এমনও তো হতে পারে, কেউ হয়তো টাকার প্রলোভন দেখিয়ে বুড়িকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে।
আমার কথায় সায় দিয়ে মেজর বললেন, হ্যাঁ, বুড়ির খুব অর্থলালসা ছিল। তোমার আশঙ্কাটাকে একারণেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এরকম সম্ভাবনার কথা তোমার মাথায় এলো কেন?
আমি বললাম, সার্জেন্ট কীন একবার কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। তা থেকেই এই ভাবনাটা আমার মাথায় এসেছে।
-কিন্তু রজার, দ্বিধাগ্রস্তভাবে মাথা নেড়ে মেজর বললেন, বুড়ি এন্তার ভয় দেখানোর ফলে তোমার স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটল, এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
–বুড়ি হয়তো ভাবতেই পারেনি এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে হয়তো ভেবেছিল, পথের মাঝখানে ঘোড়াটাকে আচমকা চমকে দিয়ে খানিকটা মজা করবে। আর একটা ঘোড়াকে অনেক রমক ভাবেই চমকে দেওয়া সম্ভব।
একটু থেমে আমি আবার বললাম, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, ইলিয়ার ওপরে বুড়ির কোন ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল। কিন্তু বিদ্বেষের কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে এ জায়গাটা তো ইলিয়ার ছিল না, খরিদ করে দখল নিয়েছিল।
তা নিয়েছিল। এটাও সত্য কথা এককালে জিপসিদের এ-অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। পছন্দমত ফাঁকা জমি পেলেই ওরা ডেরা বেঁধে বসবাস শুরু করতো। জমির মালিকের অনুমতি নেবার প্রয়োজন বোধ করত না। এখানেও সেভাবেই আস্তানা গেড়েছিল। কিন্তু পরের জমি থেকে উৎখাত হয়ে যে বরাবরের মত কোন রাগ পুষে রাখবে–এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
আমি বললাম, একথা আমিও ভেবে দেখেছি। তবে টাকা দিয়ে বশ করে বুড়িকে লেলিয়ে দেওয়া কষ্টকর বলে মনে হয় না। আমার মনে হচ্ছে এরকমই কিছু ঘটে থাকবে।
মেজর বললেন, কিন্তু কোন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বুড়িকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে যদি ধরেও নেওয়া হয়, তাহলে সেই ব্যক্তির কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে বলে তুমি মনে কর?
আমি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলাম। পরে মেজরকে বললাম, কারণ হিসেবে অনেক সম্ভাবনার কথাই তো মনে করা যেতে পারে।
সার্জেন্ট কীন যে ইঙ্গিতটা করেছিলেন,-এ-অঞ্চল থেকে আমাদের যদি কেউ উৎখাত করতে চায় তাহলে তার পক্ষে ইলিয়াকেই বেছে নেওয়া স্বাভাবিক।
কারণ আমার চেয়ে ইলিয়াকে ভয় পাইয়ে দেওয়া অনেক সহজ। আর আমরা এই অঞ্চল ছেড়ে চলে গেলে জমিটা আবার নিলামে উঠবে। অজ্ঞাতনামা সেই ব্যক্তি হয়তো বিশেষ কোন কারণে জায়গা কিনে নিতে চায়।