কথা বলতে বলতে সহসা স্যানটনিক্সের মুখের চেহারা অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেল। তিনি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে বকবক না করে চল ভেতরে যাওয়া যাক। ইলিয়ার কাছে গিয়ে বসা যাক।
সেই সন্ধ্যাতেই স্যানটনিক্সের এক নতুন রূপ আমি আবিষ্কার করেছিলাম। তিনি যে কি সাংঘাতিক চরিত্রের মানুষ সে বিষয়ে আগে আমার কোন ধারণা ছিল না।
তাকে আন্তরিকভাবেই ইলিয়া অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। তিনিও বেশ খোশমেজাজে আমাদের সঙ্গে গল্প করলেন। রীতিমত সম্মোহিতের মত গ্রেটার রূপের প্রশংসা করলেন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে। লক্ষ করলাম গ্রেটাকে যে কোন উপায়ে খুশি করার জন্যই তিনি ব্যস্ত। সারাক্ষণ তার আচারআচরণ লক্ষ্য করে উদ্দেশ্যটা আঁচ করবার চেষ্টা করলাম।
স্বাভাবিক সৌজন্য বশতঃই ইলিয়া স্যানটনিক্সকে দুচারদিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানাল। তিনি জানালেন, মাত্র একবেলার জন্যই এখানে এসেছেন। আগামীকাল সকালেই চলে যাবেন।
.
০৫.
পরদিন বিকেলে এক অভাবিত ঘটনা ঘটল। বনপথ ধরে বাড়ির দিকে ফিরে আসছিলাম। পাইনগাছের তলায় তলায় অন্ধকার ক্রমেই ঘন হয়ে আসছিল। সহসা চোখে পড়ল, অন্ধকারে গাছতলায় এক দীর্ঘকায় নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
অনুমান করলাম, জিপসি বুড়ি ছাড়া কেউ নয়। ইতিমধ্যে তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। দুকথা শুনিয়ে দেবার জন্য দু-পা এগিয়ে গেলাম।
কিন্তু সহসাই স্তম্ভিত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল আমাকে। দেখি স্থির, নিশ্চল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আমার মা।
–হায় ভগবান, প্রবল বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলে? তুমি নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছ? তা বাড়িতে গেলে না কেন?
ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মা আমার সামনে দাঁড়ালেন।
বললেন, তোমার কুশল জানতেই এসেছি আমি। ওই প্রাসাদবাড়িটা কি তোমরা নিজেদের জন্য তৈরি করেছ?
-হ্যাঁ। তোমাকে তো কতবার আসবার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তুমি কোন সাড়াই দিলে না।
কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা বললাম। বিয়ের পর একটা দায়সারা গোছের চিঠির পর মাকে আমি কোন চিঠিই আর লিখিনি।
আমি ভালকরেই জানতাম, মা কোনদিনই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। আর মায়ের আসাটাও আমার অভিপ্রেত ছিল না।
মা বলল, বাড়িটা সত্যিই সুন্দর।
–তুমি নিশ্চয় ভাবছ, আমার মত ছেলের পক্ষে খুবই জমকালো হয়ে গেছে।
–বাছা, এটা সত্যি যে, তুমি যে বাড়িতে ও পরিবেশে মানুষ হয়েছ সেই তুলনায় বাড়িটা জমকালোই বটে। সকলকে সবক্ষেত্রে নিজের সামর্থ্য ও পরিবেশের কথা মনে রেখে চলা উচিত।
মা, বরাবর দেখেছি, তুমি আমার সবকিছুতেই ভ্রু কোঁচকাও। আমি একই গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকব চিরকাল তাই কি তুমি চাও? যাকগে ওসব কথা, এখন চল বাড়ির সঙ্গে, তোমার পুত্রবধূকেও দেখবে।
–তোমার স্ত্রীর সঙ্গে আগেই আমার পরিচয় হয়েছে।
আমি বিস্মিত হলাম মায়ের কথা শুনে। বললাম, তোমার সঙ্গে আবার তার পরিচয় হল কবে?
-তোমাকে তোমার স্ত্রী দেখছি কিছুই বলেনি। সে আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য লণ্ডনে গিয়েছিল।
মাকে আমি জানি, ছলচাতুরি, মিথ্যা কখনো প্রশ্রয় দেয় না। তবু অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, লণ্ডনে গিয়ে ইলিয়া তোমার সঙ্গে দেখা করেছে?
-হ্যাঁ, সপ্তাহ কয়েক আগে হঠাৎ একদিন উপস্থিত হয়েছিল আমার বাসায়। আমি মাইকের মা জানতে পেরে নিজের পরিচয় দিল। বলল, তোমার আপত্তির ফলেই আগে আসতে পারেনি। সেদিনও তোমাকে না জানিয়েই চলে এসেছিল।
তোমার আপত্তি সম্পর্কে মেয়েটি বলল, সে ধনী পরিবারের মেয়ে, অগাধ বিত্তের অধিকারী, সে কারণে তুমি নাকি তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে চাওনি।
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, মাইক তোমাকে ঠিক কথা বলেনি। মাইকের দোষগুলো আমি জানি বলেই সে আমার কাছে আসতে লজ্জা পায়।
আমি ক্ষুণ্নস্বরে বললাম, তোমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, একথা আমাকে ইলিয়ার বলা উচিত ছিল। কথাটা কি উদ্দেশ্যে গোপন করল, বুঝতে পারছি না।
-উদ্দেশ্য আর কি থাকবে। তোমার অমতে কাজটা করেছে বলে হয়তো পরে বিব্রত বোধ করেছিল।
কথা বলতে বলতে মাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। গোটা বাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাকে দেখালাম। লক্ষ্য করলাম মায়ের ভ্র আগাগোড়া কুঞ্চিত হয়ে রইল।
ইলিয়া আর গ্রেটা বৈঠকখনা ঘরে বসেছিল। তাদের দুজনের ওপর দৃষ্টি পড়তেই মা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে
ইলিয়া মাকে দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত আনন্দ প্রকাশ করে ব্যস্ত হয়ে উঠে এল। মায়ের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে টেনে নিল।
–মিসেস রজার, কি সৌভাগ্য, আমি তো ভাবতেই পারিনি।
ইলিয়া গ্রেটাকে ডেকে বলল, ইনি মাইকের মা, আমাদের মাননীয়া অতিথি। আমাদের সংসার স্বচক্ষে দেখতে এসেছেন।
পরে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এ হচ্ছে গ্রেটা অ্যাণ্ডারসন, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
মা গ্রেটার দিকে তাকাল। মুহূর্তে তার মুখভাব কঠিন হয়ে গেল।–এ যে দেখছি…এ যে দেখছি…বলতে বলতে মা থেমে গেল।
ইলিয়া সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, কি দেখছেন–
-না, বলছিলাম, সব কিছুই বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বসেছ তোমরা। সবকিছুই বেশ পরিপাটি, মানানসই।
ইলিয়া গ্রেটাকে মায়ের জন্য চা করতে পাঠিয়েছিল। মা সোফায় এসে বসল।