লোকটা একটু থামল। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
–চলে যাবার আগে জিপসিদের বুড়ো সর্দার নাকি ভীষণ অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল।
লোকটার মুখে ওরকম একটা গ্রাম্য কথা শুনে আমি হেসে না উঠে পারলাম না।
লোকটা আমার হাসি দেখে রেগে গেল। রুক্ষস্বরে বলল, তোমাদের শহুরে লেখাপড়া শেখা ছেলেদের ওটাই দোষ। দুনিয়ার কোন খবরই রাখ না। তাই সব বিষয় নিয়েই হাসিমস্করা কর।
আমি লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ দুটো কেমন চকচক করছে। বলল, বিধাতার এই সংসারে এমন কিছু জায়গা আছে যেগুলো অভিশপ্ত। ওই জিপসি একরও তার মধ্যে একটা।
বাড়িটা তৈরির সময় সবাই জানে, খাদ থেকে পাথর বয়ে আনার সময় অনেক শ্রমিক মারা গিয়েছিল।
একটু থেমে আমার মুখে একপলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ফের বলল, এই গ্রামের বুড়ো জর্জ, তাকেও একরাতে ওখানে ঘাড় মটকে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল।
–তাতে কি, নিশ্চয় মাতাল হয়ে পথ চলেছিল।
–বুড়ো মদ খেত ঠিকই তবে তেমন বেশি কিছু না। কিন্তু অনেকেই তো মদ খেয়ে ওই পথে চলাচল করে। তাদের কেউ তো জর্জের মত ঘাড় মটকে পড়ে থাকে না।
পাইন গাছে ঢাকা সবুজ পাহাড়ের কোলে জিপসি একর সেই দিনই আমাকে যেন কোন অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলল। সেই মুহূর্তে আমি কি ভাবতে পেরেছিলাম যে এখান থেকেই আমার কাহিনীর সূত্রপাত হবে?
শুরু থেকে সমস্ত ঘটনা আমার স্মৃতিতে হুবহু আঁকা হয়ে আছে।
অনাবশ্যক কৌতূহল বসেই লোকটাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তা সেই জিপসিরা তারপর কোথায় গেল?
–কোথায় গেল কেউ জানে না। আজকাল তাদের কাউকেই আর এ তল্লাটে দেখা যায় না। পুলিসও সতর্ক নজর রেখেছে।
আমি বললাম, অনেককেই দেখি জিপসিদের নাম শুনতে পারে না। তাদের ঘৃণা করে, না ভয় করে বুঝতে পারি না।
–ওরা হল ছিঁচকে চোরের দল।
বলতে বলতেই আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
তারপর ধীরে ধীরে বলল, তোমার মধ্যেও তো দেখছি খানিকটা জিপসি রক্ত রয়েছে, তাই না?
চট করেই লোকটার প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। আমি ভাল করেই জানি জিপসিদের সঙ্গে আমার চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু লোকটাকে সেকথা আমি সেই মুহূর্তে বলতে পারলাম না।
দু চোখে কৌতুকের ঝিলিক নিয়ে আমি লোকটার দিকে তাকালাম। তার চোখের দৃষ্টি দেখেই কেন জানি না সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, সত্যি সত্যিই হয়তো আমার শরীরে জিপসি রক্ত মিশে আছে।
লোকটার কাছ থেকে সরে এসে আমি পাহাড়ী পথটা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।
রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে, পথের শেষ প্রান্তে পাহাড়ের চূড়াতে জিপসি একর। ওদিকটা বেশ সমতল।
হাঁটতে হাঁটতে চুড়ায় উঠে চোখে পড়ল দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। নজরে পড়ল বহুদূর দিয়ে স্টীমার যাতায়াত করছে।
দৃশ্যটা মনোরম সন্দেহ নেই। পাহাড়ে বসে সমুদ্র দেখা, ভাবতেই বুকের ভেতরে পুলক নৃত্য করে ওঠে। কেন জানি না, হাস্যকর ভাবেই মনে হল, আহা, জিপসি একর যদি আমার হত।
পাহাড়ের ওপরে বেশিক্ষণ থাকিনি। ফেরার পথে সেই প্রৌঢ় লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখনো সে ঝোপঝাড়ে কঁচি চালিয়ে চলেছে।
আরো কিছু কথাবার্তা হল তার সঙ্গে। আমার কথায় সে কি বুঝল কে জানে, বলল, এখানে যদি কোন জিপসির সঙ্গে কথা বলতে চাও তাহলে একজনের কথা বলতে পারি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে সে?
মিসেস লী নামে এক জিপসি বুড়ি আছে। মেজরই তাকে এখানে এনে বসবাস করিয়েছে।
–এই মেজরটি আবার কে?
লোকটার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হল। অদ্ভুত স্বরে বলল, তুমি মেজর ফিলপটের কথা শোননি?
-না, ভাই সেই সৌভাগ্য হয়নি। কে এই ফিলপট বলতো?
তার কাছ থেকে যা শোনা গেল তাতে বুঝলাম, এই অঞ্চলের লোকের কাছে মেজর ভদ্রলোক দেবদূতের মতই শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র। তারা এখানকার বনেদী পরিবার। লীকে মেজরই সাহায্য দিয়ে রেখেছেন।
আমি আর বিশেষ কৌতূহল দেখালাম না কোন বিষয়েই। যখন চলে আসছি, লোকটা যেন আপন মনেই বলে উঠল, একেবারে শেষ মাথার কুঁড়েটাতেই বুড়ি লী থাকে। কিন্তু ঘরে থাকে না একমুহূর্তের জন্য। আশপাশেই ঘুরঘুর করে বেড়ায়। জিপসি বলেই হয়তো ঘরে থাকতে চায় না।
শিস দিতে দিতে আমি পাহাড়ী পথ ধরে নিচের দিকে নামতে লাগলাম। জিপসিদের কথাটাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। কখন যে মিসেস লীর কুঁড়ের কাছাকাছি চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি।
একমাথা রুক্ষ তামাটে চুলের বুড়ি তার উঠোনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। সামনাসামনি চলে এসেই আমার খেয়াল হল।
কোমর ছাপানো চুলের রাশি বাতাসে উড়ছে। একপলকেই চিনতে পারলাম এই হল জিপসি বুড়ি লী।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কাছেই তো আসছিলাম। শুনলাম, বহুদিন ধরে এই অঞ্চলে রয়েছ?
রোমশ পাকা ভ্রূজোড়ার ফাঁক দিয়ে বুড়ি আমাকে বড় বড় চোখ করে দেখল। তারপর খসখসে গলায় বলল, তোমাকে দেখতে শুনতে তো ভালই লাগছে, কিন্তু এটা জান না, সব ব্যাপার নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়। তোমাকে এখানে কে টেনে এসেছে? যদি ভাল চাও তো জিপসি একরের কথা মন থেকে মুছে ফেল। এখানে অভিশাপ আছে, কারুর কোন দিন মঙ্গল হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।