–কি বলছিল বুড়ি। সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
–বুড়ি বলছিল, আমরা নাকি জিপসিদের এলাকা জোর করে দখল করে রেখেছি। এখান থেকে চলে না গেলে আমাদের মঙ্গল হবে না।
এখানে নাকি অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপ আছে–এখানে বাড়ি তৈরি করে আমরা সেই অভিশাপ কুড়িয়েছি। আমাদের সর্বনাশ হবে।
গ্রেটা সেদিন আরও অনেক কথা বলেছিল। ইলিয়া পরে আমাকে আড়ালে বলেছিল, ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল ঠেকছে না মাইক।
আমি বললাম, গ্রেটা তো বানিয়ে কিছু বলবার মেয়ে নয়। ও যা বলল, তা তো ভীতিপ্রদ।
হঠাৎ একটা চিন্তা আমার মাথায় এল। ইলিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, পাহাড়ী পথে ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াবার সময় ইতিমধ্যে জিপসি বুড়ির সঙ্গে তোমার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?
ইলিয়া কেমন দ্বিধা করল জবাব দিতে। বুঝতে পেরে বললাম, মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
-হ্যাঁ। জঙ্গলের আড়ালে-আবডালে বুড়িকে দু-একবার আমার চোখে পড়েছে। জঙ্গলের গাছপালার আড়াল থেকে কেউ যেন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আমি বুঝতে পারি। কিন্তু চিনতে পারি না কে।
একদিন বেশ বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ইলিয়া ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি ফিরে এল। মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। হাত পা কাঁপছে থরথর করে।
উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি খুব ভয় পেয়েছ ইলিয়া?
–জান, মাইক, আজ বুড়ি ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আমি তার সঙ্গে কথা বলার জন্য ঘোড়া থামালাম। বুড়ি তখন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আকাশের দিকে তুলে কি সব বকবক করতে লাগল।
মনে হয় অভিশাপ দিচ্ছিল। আমার খুব রাগ হয়ে গেল। বললাম, তুমি কেন আমাদের ভয় দেখাচ্ছ? এ জমি তোমাদের নয়, আমরা কিনে নিয়েছি। বরাবর এখানে বাস করব, সেজন্য বাড়ি তৈরি করেছি।
বুড়ি তেজের সঙ্গে বলল, এ জমি কখনো তোমাদের নয়। এ জমি জিপসিদের। তোমাকে আগেও আমি সাবধান করেছি, আজ শেষবারের মত সাবধান করে দিলাম। আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমার বাঁ কাঁধের পেছনে মৃত্যু থাবা বাড়িয়েছে।
আর দেরি নেই। তুমি যে ঘোড়াটার ওপরে চড়ে আছ, তার একটা পা সাদা। এটা কিসের লক্ষণ জান? মৃত্যু। মৃত্যু। এত সাধ করে জিপসিদের জমিতে যে বাড়ি বানিয়েছ, সেই বাড়িও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।
কথাগুলো বলতে বলতে ইলিয়া ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। বারবার তার ঠোঁট শুকিয়ে আসতে লাগল।
গ্রেটাও বেশ বিচলিত হয়ে পড়ল। আমিও আর হেসে উড়িয়ে দিতে পারলাম না।
-বুড়ি দেখছি, খুবই বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। এর একটা সুরাহা করা এখুনি দরকার।
বলে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বুড়ি লীর সঙ্গে আগে কথা বলব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু ঝুপড়িতে তাকে পাওয়া গেল না। সরাসরি চলে এলাম থানায়।
থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সার্জেন্ট কীন-এর সঙ্গে ইতিপূর্বে আমার পরিচয় হয়েছিল। বেশ বুদ্ধিমান ও বিবেচক ব্যক্তি। আমার সবকথা তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।
তারপর জানালেন, বুড়ি লীকে নিয়ে আগে কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এখন দেখছি, ওকে ডেকে একটু শাসিয়ে দেবার দরকার হয়েছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মিঃ রজার, বুড়ি আর এমন ব্যবহার করতে সাহস পাবে না।
সার্জেন্ট কীনকে ধন্যবাদ জানিয়ে যখন উঠে আসছি তখন তিনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব মিঃ রজার। আচ্ছা আপনার বা আপনার স্ত্রীর ওপর কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে, এমন ঘটনা কি কিছু ঘটেছে?
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছেন কেন?
–আমার কাছে একটা খবর আছে, আজকাল বুড়ি বেশ পয়সা-কড়ি খরচ করতে পারছে। কি করে এসব ও করছে, তার কোন হদিশ পাইনি।
ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকছে।
–আমার ধারণা, আপনাদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে চায় এমন কোন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বুড়িকে টাকা জোগাচ্ছে। এই রকম একটা ব্যাপার বেশ কয়েকবছর আগে এখানে ঘটেছিল। এক ব্যক্তি টাকা দিয়ে বুড়িকে হাত করেছিল, উদ্দেশ্য ছিল এক প্রতিবেশীকে উৎখাত করা। গ্রামের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষজনের মধ্যে বুড়ির উদ্ভট এবং ভয়-দেখানো কথাবার্তা সহজেই প্রভাব বিস্তার করে। আর বুড়ির মত দরিদ্র লোকজনকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে সহজেই বশ করা যায়।
আমি বললাম, আমরা তো এই অঞ্চলে নবাগত। এখনো সকলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় পর্যন্ত হয়নি।
–ঠিক আছে, আমি দেখছি ব্যাপারটা।
সার্জেন্টের কথায় বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। খুব বিরক্তও লাগছিল। শান্তিভঙ্গের এমন অনাহূত কাণ্ড কেন ঘটছে বুঝতে পারছিলাম না।
গেট দিয়ে ঢুকতেই গীটারের শব্দ কানে এলো। ইলিয়া তার স্প্যানিশ গীটারটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। মাঝে মাঝে গীটার বাজিয়ে গুনগুন সুরে গান করতে ভালবাসে ও। গীটারের সঙ্গে সেই গান শুনতেও বেশ ভাল লাগে। ভাবলাম কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করব, এই সময় হাজির হয়ে ওকে বাধা দেব না।
এমন সময় ব্যাপারটা চোখে পড়ল আমার। দেখলাম, কে একজন বাইরে দাঁড়িয়ে বৈঠকখানা ঘরে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছে।
কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম। আগন্তুক পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। চিনতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। স্বয়ং মিঃ স্যানটনিক্স।
ওঃ, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মশায়। অনেকদিন আপনার কোন খবর পাইনি। এখানে কবে এলেন?