কোরা চলে যাবার পর একদিন বিকেলে আমাদের সেই গোপন আস্তানা থেকে ফেরার পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটল। পাথরে পা হড়কে পড়ে গিয়ে ইলিয়ার একটা পা বেশ জখম হল।
পাঁজাকোলা করে তাকে নিয়ে আসতে হল। ডাঃ শকে খবর দেওয়া হল। তিনি এসে পরীক্ষা করে জানালেন, হাড় ভাঙেনি, তবে আঘাতটা গুরুতর। অন্তত সপ্তাহ খানেক বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।
ইলিয়াকে সেবাশুশ্রূষার ব্যাপারে খুবই আতান্তরে পড়ে গেলাম। দাস-দাসীদের দিয়ে সে কাজটা হওয়া সম্ভব ছিল না।
ইলিয়া গ্রেটাকে দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে তার করেছিল। সংবাদ পাওয়া মাত্র গ্রেটা এসে হাজির হল এবং বাড়ির কাজকর্মের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ইলিয়াও যেন প্রাণ ফিরে পেল।
ইতিমধ্যে দাসদাসীরা ঝামেলা পাকিয়ে বসল। এমন নির্জন জায়গায় তারা থাকতে রাজি হল না। এমন একটা কাণ্ডের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না, কোরা এসেই ওদের বিগড়ে দিয়ে গেছে।
গ্রেটা কিন্তু তোয়াক্কাই করল না। তড়িঘড়ি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে সে একদিনের মধ্যেই আর একপ্রস্থ দাসদাসীর ব্যবস্থা করে ফেলল।
গ্রেটার সেবাযত্নে ও তত্ত্বাবধানে ইলিয়া শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠল। তার পরেও কিন্তু গ্রেটা রয়ে গেল।
অবশ্য ইলিয়া আমাকে আড়ালে জানিয়েছিল। গ্রেটা যদি কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকে, কেমন হয়?
আমি সহাস্যে জানিয়েছিলাম, তাহলে তো ভালই হয়। তোমার বন্ধু যতদিন খুশি থাকুন ।
গ্রেটা থেকে গেল এবং ঘরগৃহস্থালীর সমস্ত কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে নিজের হাতে নিয়ে নিল। তার নির্দেশেই এখানকার সব কাজ হতে লাগল।
একদিন লাঞ্চের পরে ইলিয়া বসার ঘরে সোফায় শুয়ে একটা ফ্যাশনের ম্যাগাজিন দেখছিল। বাইরের বারান্দায় মুখোমুখি চেয়ারে বসে আমি আর গ্রেটা গল্প করছিলাম। এই সময় একটা বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ উপস্থিত হল।
সেই থেকে কথাকাটাকাটির সূত্রপাত। কেউ কারুর গোঁ ছাড়ছিলাম না। ফলে উত্তপ্ত কথাবার্তা ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে গেল। তীব্র ঝঝের সঙ্গে দুজনেই দুজনকে বেশ দু-চার কথা শুনিয়ে দিলাম।
গ্রেটা যে ক্ষমতাপ্রিয়, ইলিয়াকে সুকৌশলে নিজের কজায় পুরে ফেলেছে এসব কথাও যথেষ্ট তিক্ততার সঙ্গে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
সেদিনই প্রথম দেখলাম, সুন্দরী গ্রেটা রেগে গেল কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত অসুস্থ শরীরে ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে এসে ইলিয়া আমাদের সামাল দিল।
ইলিয়া কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সোফায় নিয়ে ওকে বসিয়া দেবার পরে বলল, মাইক, তুমি যে মনে মনে গ্রেটাকে এমন ঘৃণা কর আমি ধারণা করতে পারিনি।
ইলিয়াকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম। বললাম, রেগে গেলে আমি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। মুখ দিয়ে কি বেরয় তা আমি নিজেও জানি না। এ নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি গ্রেটার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব।
শেষ পর্যন্ত গ্রেটার কাছে মার্জনা ভিক্ষা করে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করেছিলাম। অনেক সাধ্যসাধনার পর গ্রেটা আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হল।
ডাঃ শ এসে জানিয়ে দিয়ে গেলেন ইলিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ। এখন স্বচ্ছন্দে হাঁটাচলা করতে পারে। তবে উঁচুনিচু পথে হাঁটাচলা করার সময় আহত গোড়ালিটা পুরু কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিতে হবে।
কথায় কথায় ডাক্তারের কাছে আমি ডানতে চাইলাম, ইলিয়ার শরীর বা হার্ট সম্পূর্ণ সুস্থ কিনা।
আমার এই প্রশ্নটা করার কারণ হল, একদিন গ্রেটা আমাকে জানিয়েছিল, ইলিয়া ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ডাঃ শ ইলিয়াকে পরীক্ষা করে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে জানালেন, শরীরে কোনদিক থেকেই ইলিয়ার দুর্বলতার কোন চিহ্ন নেই। সে সম্পূর্ণভাবেই সুস্থ।
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। ইলিয়াও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, গ্রেটা আমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে অযথাই উদ্বিগ্ন হয়।
স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে ক্রমশই ইলিয়ার বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল। বিশেষ করে ক্লডিয়া হার্ডক্যাসল এখন প্রতিদিনই আমাদের এখানে আসে। ইতিমধ্যে ইলিয়া একটা ঘোড়া কিনেছে। দুজনে মিলে মাঝে মাঝে ঘোড়া চড়ে ঘুরে বেড়ায়।
ঘোড়ায় চড়ার ব্যাপারে আমি ততটা উৎসাহী নই। যদিও আয়ার্ল্যাণ্ডের এক আস্তাবলে কিছুদিন কাজ করেছি আমি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় ঘোড়া চড়াটা শিখে নিলে মন্দ হয় না।
ইলিয়া ছোটবেলা থেকেই ঘোড়া চড়ায় অভ্যস্ত। ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে বিশেষ আনন্দ পায় ও। গ্রেটাও তাকে এব্যাপারে উৎসাহ যোগায়।
ক্লডিয়ার পরামর্শেই একটা বাদামি রঙের ঘোড়া কিনেছিল ইলিয়া। তার পর থেকে হপ্তায় দু-তিন দিন সে সকালে উঠে ঘোড়া নিয়ে বেরুত।
ঘরগেরস্থালীর কেনাকাটার প্রয়োজন থাকলে গ্রেটা নিজেই গাড়ি নিয়ে মার্কেট কডওয়েল চলে যেত। একদিন দুপুরের খাওয়ার টেবিলে বসে ও বলল, আজ সকালে এক ডাইনীর মত দেখতে বুড়ি আমার পথ আগলে ছিল। ক্রমাগত হর্ন শুনেও রাস্তার মাঝখান থেকে সরছিল না। ফেরার পথেও বুড়ি একই কাণ্ড করল।
আমরা বুঝতে পারলাম জিপসি বুড়ি লীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। ইলিয়া তার পরিচয় জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, বুড়ি তোকে কিছু বলেছিল?
গ্রেটা বলল, কুৎসিত বুড়িটা আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল।