ভদ্রলোকের বেশ অমায়িক চেহারা। পোশাকআশাকও অতি সাধারণ। মাথার চুলের বেশিটাই সাদা, বয়স ষাটের কাছাকাছি।
বৈঠকখানা ঘরে এসে নিজেই চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর বেশ অন্তরঙ্গভাবে কথাবার্তা শুরু করলেন।
নানান প্রসঙ্গ নিয়েই আমাদের আলোচনা হতে লাগল। কথায় কথায় ইলিয়া একসময় বলল, জিপসিদের অভিশাপের গল্প শুনিয়ে বুড়ি লী তো আমাদের রীতিমত ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। মনে হয় ছিটগ্রস্ত।
বুড়ি এন্থার এমনিতে বিশেষ উৎপাত করে না। আমিই ওকে কুঁড়েটার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। যুবক-যুবতীদের দেখতে পেলে পয়সার লোভে তাদের ভবিষ্যতের কথা শুনিয়ে খুশি করবার চেষ্টা করে।
–কিন্তু আমাদের তো আশাভরসার কোন কথাই শোনাল না। নানানভাবেই সাংঘাতিক ভয় ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। ও তো আমাদের এখানে আসতেই নিষেধ করছিল।
মেজর ভ্রূকুঞ্চিত করে বললেন, ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই অবাক লাগছে। তরুণ-তরুণীদের মনজোগানো কথাবার্তাই তো বুড়ির মুখে সবসময় শোনা যেত। কিন্তু কখনো ওর মুখ থেকে কোন অমঙ্গলের আশঙ্কার কথা তো শোনা যায়নি।
খানিক বিরতির পর মৃদু হেসে মেজর পুনরায় বললেন, আমার ছেলেবেলায় এ অঞ্চলে অনেক জিপসির আস্তানা ছিল। চুরিটুরির অভিযোগ শোনা যেত ওদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এদের আমার খুব ভাল লাগত।
একবার আমার এক ভাই গ্রামের পুকুরে ডুবে মরতে বসেছিল। বুড়ি লী তাকে বাঁচিয়েছিল। এই কারণেই আমি ওর প্রতি কৃতজ্ঞ।
এইসময় অসতর্কভাবে ধাক্কা লেগে আচমকা সুদৃশ্য ছাইদানি মেঝেয় পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
আমি অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি ভাঙ্গা টুকরোগুলো একজায়গায় জড়ো করলাম।
ইলিয়া বলল, আপনার কথা শুনে বুঝতে পারছি বুড়ি লী আসলে খুবই নিরীহ আর শান্ত প্রকৃতির। ওকে ভয় পাবার কিছু নেই।
মেজর ভ্রূকুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন, ও কি আপনাকে কোন ভয়ের কথা বলেছিল?
আমি বললাম, বুড়ি সেদিন এমনভাবে শাসিয়েছিল যে ভয় পাওয়াটা ইলিয়ার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক।
–বুড়ি লী–শাসিয়েছিল? অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন মেজর।
বললাম, তার কথাগুলো সেরকমই ছিল। তার পর আমরা যেদিন প্রথম এলাম এখানে, সেদিনই এমন একটা অভাবিত ঘটনা ঘটল যা খুবই ভীতিপ্রদ।
আমি মেজরকে জানালার শার্সি ভাঙার ঘটনাটা খুলে বললাম।
মেজর বললেন, বদমাস ছেলেছোকরাদের কাণ্ড। ব্যাপারটা দেখতে হবে। সত্যিই এটা খুব দুঃখের ব্যাপার। প্রথম দিনেই–
তবে তার চাইতেও মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে মাত্র দিনদুয়েক আগে, ইলিয়া বলল।
এই ঘটনাটাও মেজরকে খুলে বললাম। দিনদুয়েক আগে সকালে বেড়িয়ে ফেরার সময় দেখি একটা ছুরিবিদ্ধ মরা পাখি আমাদের দরজার সামনে পড়ে আছে। ছুরির ডগায় গাঁথা একটুকরো কাগজে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা ছিল–নিজেদের মঙ্গল চাও তো জিপসি একর ছেড়ে অবিলম্বে চলে যাও।
মেজর ফিলপট রীতিমত রেগে গেলেন ঘটনাটা শুনে। বললেন, সাংঘাতিক কাণ্ড, এতো রীতিমত শাসানো। কোন ছিঁচকে বদমায়েশের কাণ্ড বলে তো মনে হচ্ছে না।
–পুলিসকে তোমরা এঘটনা জানিয়েছিলে?
ইলিয়া বলল, আমরা নতুন এসেছি, প্রথমেই এতদূর যেতে চাইনি। তাতে অপরাধী রেগে গিয়ে হয়তো সাংঘাতিক কোন কাণ্ড ঘটিয়ে বসতে পারে।
–ব্যাপারটার পেছনে দুরভিসন্ধি রয়েছে। কারুর মনে বিদ্বেষভাব থাকলে এরকম ভাবে শাসানো সম্ভব। কিন্তু কিন্তু তোমরা তো এখানে নতুন এসেছ–স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ভাল করে আলাপ-পরিচয়ই তো হয়নি।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। বিদ্বেষের প্রশ্ন আসবে কেন?
–বেশ, আমি নিজেই ব্যাপারটার খোঁজখবর করব।
তারপর আরও দু-চারটে কথা বলে মেজর বিদায় নিলেন। যাবার আগে আশপাশে নজর বুলিয়ে বললেন, তোমাদের বাড়িটা সত্যিই সুন্দর। ঘরগুলো বেশ বড় বড়-হাওয়া-বাতাস খেলবার উপযুক্ত।
আজকাল তো সব পায়রার খোপের মত ঘর তৈরি হচ্ছে। এটাই নাকি ফ্যাসান। আমার দুচক্ষের বিষ। তোমাদের বাড়িটা খুব উঁদে স্থপতি তৈরি করেছেন নিশ্চয়?
আমি তাকে স্যানটনিক্সের বিষয়ে বলেছিলাম। শুনে মাথা নেড়ে বললেন, স্যানটনিক্স সম্পর্কে একটা আলোচনা তিনি হাউস অ্যাণ্ড গার্ডেন নামক পত্রিকায় দেখেছেন।
বাড়ি ছাড়বার আগে তিনি আমাদের একদিন তার বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।
নিজের গাড়ি চেপেই এসেছিলেন মেজর ফিলপট। একটা স্প্যানিয়েল কুকুর দেখলাম রয়েছে গাড়ির মধ্যে। গাড়িটা অবশ্য পুরনো।
মেজরের আন্তরিক ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। খুব সহজেই তিনি আপন করে নিতে জানেন। ইলিয়াকে খুবই স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তবে আমার সম্পর্কে তার মনোভাবটা বোঝা গেল না। যাই হোক ভদ্রলোক যে যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন তা বোঝা গেল স্পষ্ট।
ফিরে এসে দেখি, ইলিয়া ভাঙ্গা অ্যাশট্রের টুকরোগুলো পরিষ্কার করছে। আমাকে দেখে বলল, মেজর খুব সজ্জন ব্যক্তি।
.
পরের সপ্তাহেই মেজরের বাড়িতে আমাদের লাঞ্চের নিমন্ত্রণ হল। আমাদের সম্মানে আরও কয়েকজন সম্ভ্রান্ত প্রতিবেশীকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মেজর সকলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
স্থানীয় ডাক্তার বৃদ্ধ শ বেশ সাদাসিদে ধরনের মানুষ। জরুরী একটা কল ছিল বলে সেদিন তিনি লাঞ্চ শেষ হবার আগেই বিদায় নিয়ে নিলেন।