কাচের টুকরো লেগে ইলিয়ার কপাল সামান্য কেটে গিয়েছিল। সামান্য রক্তপাত হয়েছে। কাগজের ন্যাপকিন দিয়ে সযত্নে তা মুছে দিলাম।
ইলিয়া বলল, এমন একটা কাজ কে করতে যাবে? কি উদ্দেশ্যেই বা করবে?
পরিবেশটা হাল্কা করবার জন্য আমি বললাম, বদমাইশ ছেলেছোকরাদের কাণ্ড ছাড়া আর কি হবে। মজা করার জন্যই ওরা এরকম উপদ্রব করে থাকে।
কিন্তু ব্যাপারটা আমি অত সহজ করে নিতে পারছি না। খুবই ভীতিপ্রদ ঠেকছে।
আমি বললাম, স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পর্কে আমরা এখনো কিছুই জানি না। কাল সকালে অনুসন্ধান করে দেখা যাবে।
ইলিয়া স্যানটনিক্সের উদ্দেশ্যে বলল, আমরা বড়লোক, অনেক পয়সা খরচ করে বাড়ি করেছি, এরকম ক্ষোভ থেকেই কি কেউ এমন কাণ্ডটা করল? নাকি অন্য কোন কারণ? মিঃ স্যানটনিক্স, জিপসিদের অভিশাপের গল্পটা তো আপনিও শুনেছেন। এখানে যারা বাস করতে আসবে তারাই নাকি সেই অভিশাপের শিকার হবে। তাহলে কি এসব সত্যি?
ইলিয়া যথেষ্ট বিচলিত হয়ে পড়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে স্যানটনিক্স বললেন, আমার মনে হয়, এসব কোন কারণ নয়–
–তাহলে কি কেউ আমাদের এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে? আমাদের দুজনের স্বপ্ন দিয়ে গড়া এই বাড়ি থেকে?
আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম, আমাদের এখান থেকে কেউ উৎখাত করতে পারবে না। আমি সবরকমের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব। তোমার কোন ক্ষতি কেউ করতে পারবে না।
ইলিয়া পুনরায় স্যানটনিক্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে তো বাড়ির কাজের সময় বেশ কয়েকদিন থাকত হয়েছিল। তখন কি কোনভাবে বাড়ি তৈরির কাজে বাধা সৃষ্টি হয়েছিল?
–বাধা সৃষ্টি হবার মত কিছু ঘটেনি। স্যানটনিক্স বললেন, অতবড় একটা বাড়ি তৈরি হল, সামান্য দু-একটা ঘটনা ঘটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কাজের সময় মই থেকে পড়ে গিয়ে একজন মজুর চোট পেয়েছিল। আর একজন মজুরের হাত ফস্কে একটা পাথরের বোঝা তার পায়ের ওপর পড়েছিল।
একজনের পায়ের আঙুলে পেরেক ফুটে বিষিয়ে উঠেছিল–এগুলো উল্লেখ করবার মত মারাত্মক কিছু ঘটনা নয়।
–আর কিছু ঘটেনি?
–না ইলিয়া, আমি তোমাকে শপথ করে বলতে পারি। বললেন স্যানাটনিক্স।
–আমার কেবলই সেই জিপসি বুড়ির কথা মনে পড়ছে। প্রথম দিনেই দেখা হতে সে আমাদের এখানে আসতে নিষেধ করেছিল। কী সাংঘাতিক ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। ইলিয়া বলল।
–ওই ছিটেল বুড়ির কথা বাদ দাও। বললাম আমি।
-আমরা যেখানে বাড়ি তৈরি করেছি, বিশেষ করে এই জায়গাটা সম্পর্কে বুড়ি লী আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল। আমরা এখানেই থাকব। কারুর সাধ্য হবে না আমাদের এখান থেকে উৎখাত করে।
বেশ রাগত ভঙ্গিতেই ইলিয়া কথাগুলো বলল।
আমিও তাকে সমর্থন জানিয়ে বললাম, তুমি নিশ্চিন্ত থাক, সে সুযোগ কেউ পাবে না।
সেদিন এভাবেই আমরা অদৃশ্য নিয়তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম।
.
০৩.
জিপসি একরের নতুন বাড়িতে এভাবেই আমাদের দুজনের জীবন শুরু হয়েছিল।
বাড়িটার একটা জুতসই নাম খুঁজে পাবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম দুজনে।
ইলিয়া মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিল। পরদিন ইলিয়া আমাকে বলল, জায়গাটার নামবদলের চেষ্টা করব না আমরা। জিপসি একর নামই রাখব। সম্পত্তিটা এখন আমাদের। জিপসিরা কবে কি বলেছে না বলেছে তাতে আমাদের কি এসে যায়।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য সেদিন আমরা হেঁটে গ্রামের দিকে রওনা হলাম। জিপসি বুড়ির ঝুপড়ির কাছে এসে দেখা গেল তার দরজায় তালা ঝুলছে।
একজন প্রৌঢ়াকে পথে পাওয়া গেল। তাকে জিজ্ঞেস করতে জানাল, অন্য কোথাও গিয়ে থাকবে। বুড়ি তো মাঝেমাঝেই দু-চার দিনের জন্য এমনি বেপাত্তা হয়ে যায়। জিপসিদের স্বভাবই ওরকম। একজায়গায় বেশিদিন থাকতে পারে না।
বৃদ্ধা জানতে চাইল, পাহাড়ের উঁচুতে নতুন বাড়িটা আপনারাই তো তৈরি করেছেন?
আমি সায় দিয়ে বললাম, সবে গতরাত্রে আমরা এখানে এসে পৌঁচেছি।
–আপনাদের ওই জায়গাটা খুবই সুন্দর। ওই বাড়িটাও সুন্দর। জিপসি একরের চেহারাটাই পাল্টে গেছে। তবে চারপাশটা খুবই নির্জন। অনেকেই আবার অমন গাছপালা ঘেরা জায়গায় বেশিদিন থাকতে চায় না।
জায়গাটাকে লোকে এত ভয় পায় কেন? ইলিয়া জানতে চাইল।
-তাহলে গল্পটা আপনাদের কানেও পৌঁচেছে। আগে ওখানে যে বাড়িটা ছিল তার নাম ছিল টাওয়ার।
ইলিয়া বলল, আমরা ঠিক করেছি বাড়িটার নাম রাখব জিপসির বাগান।
আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, বাঃ, এই তো সুন্দর নাম পেয়ে গেছ।
–হ্যাঁ, এইমাত্র মাথায় এল।
সেদিন গ্রামের আরো কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।
এরপর জিপসি একরকে ঘিরে আমাদের নানা ধরনের পরিকল্পনা চলতে লাগল।
ইতিমধ্যে গ্রেটা এসে সাপ্তাহিক ছুটির দুদিন আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে গেল। বাড়িটার আসবাবপত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল। রবিবার বিকেলেই ও চলে গেল।
এই দুদিন ইলিয়া গ্রেটাকে নিয়েই মেতে ছিল। কাছে থাকায় বুঝতে পারলাম, গ্রেটা তার কত প্রিয়। এই অন্তরঙ্গতা আমার অপছন্দ হলেও নিজেকে মার্জিত হাসি ও ব্যবহার দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলাম।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আমাদের কিছুটা আলাপ পরিচয় হয়ে গেল। অনেকটাই স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠলাম আমরা।
একদিন বিকেলে মেজর ফিলপট এলেন। ইলিয়াকে ইতিপূর্বেই ফিলপটের পরিচয় জানিয়েছিলাম। স্থানীয় বাসিন্দারা মেজরকে ঈশ্বরের মত ভক্তিশ্রদ্ধা করে।