ইলিয়া সলজ্জ প্রতিবাদের সুরে বলল, না না, আদেশ বলবেন না, আমি আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম।
স্যানটনিক্স বললেন, তোমরা যে জিপসি একর কিনে নিয়েছ, দিনকতক আগে আমি সেই জায়গাটা ঘুরে দেখে এসেছি। দেখলাম জায়গাটা পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয়ে গেছে।
এরপর বাড়ির নক্সাটা স্যানটনিক্স আমাদের বুঝিয়ে দিলেন। জলরঙের একটা ছবিও করা ছিল পর বাড়িতে এসেছি।
ইলিয়া সব দেখেশুনে উচ্ছ্বসিতভাবে বলে উঠল, আমার স্বপ্নের বাড়িটিই যেন আমি দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।
স্যানটনিক্স জানালেন খুব শিগগিরই লণ্ডনে এসে তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন।
স্যানটনিক্সের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা এথেন্সে ফিরে এলাম।
ওখান থেকে ইলিয়া কয়েকটা জরুরী চিঠি লিখল। একটা লিখল তার সম্মাকে। আর দুটো ফ্র্যাঙ্ককাকা ও অ্যান্ড্রুকাকার কাছে।
তার এই অ্যান্ড্রকাকার সম্পর্কে জানতে চাইলে বলল, ইনি তার নিজের কাকা নন, আত্মীয়ের মধ্যেও পড়েন না। আসলে ইনি হচ্ছেন তার আইনসঙ্গত অভিভাবক। বাবাই সব ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। ভদ্রলোক একজন আইনজীবী।
এখান থেকে আমিও আমার মাকে একটা চিঠি লিখলাম। অবশ্য সত্যিকথা বলতে ইলিয়াই আমাকে লিখতে বাধ্য করল।
আমি মাকে লিখলাম
মা,
মনে কেমন একটা সঙ্কোচ ছিল, তাই তোমাকে আগে লেখার সাহস পাইনি। তিন সপ্তাহ আগে আমি বিয়ে করেছি। ব্যাপারটা হঠাই হয়ে গেল। এই মেয়েটির কথাই তোমাকে বলেছিলাম। আমার স্ত্রী বেশ সুন্দরী এবং অগাধ সম্পত্তির অধিকারী। সেইজন্য মাঝে মাঝে বড় অস্বস্তি বোধ হয়।
ভাবছি ফিরে গিয়ে, কাছাকাছি কোথাও একটা বাড়ি তৈরি করব। এখন আমরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ভালোবাসা নিও।–স্নেহের মাইক
লণ্ডনে হোটেল ক্ল্যারিজে আগে থেকেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে রাখা ছিল। লণ্ডনে ফিরে এখানে এসেই উঠলাম আমরা।
স্যানটনিক্সের সঙ্গে কথা বলে নতুন বাড়ির কাজ শুরু করার সব ব্যবস্থাই করে আসা হয়েছিল। তিনি যথাসম্ভব দ্রুত বাড়ির কাজ শেষ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। তাই আমরা স্থির করলাম, হোটেল থেকে একবারে নতুন বাড়িতেই গিয়ে উঠব আমরা।
.
০২.
একসময় নতুন নির্মীয়মাণ বাড়ির কাজ শেষ হল। স্যানটনিক্সের টেলিগ্রাম পেয়ে আমরা একদিন দেখতে রওনা হলাম।
বেলা শেষ হবার মুখে আমরা জিপসি একরে এসে পৌঁছলাম। স্যানটনিক্স এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। সদ্য সমাপ্ত হয়েছে বাড়ির কাজ। বাড়ির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলাম।
এই তো আমার সেই মনের মত বাড়ি, আবাল্য যার স্বপ্ন দেখে এসেছি। এতদিনে তা বাস্তব হয়ে ধরা দিল।
স্যানটনিক্স প্রশ্ন করলেন, বাড়ি পছন্দ হয়েছে?
অভিভূত স্বরে কেবল বলতে পারলাম, এর তুলনা নেই।
–এটাই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। অবশ্য এর জন্য তোমাদের অর্থও যোগান দিতে হয়েছে অপরিমিত।
সেইদিনই আমি চিরচরিত প্রথা মেনে সস্ত্রীক গৃহপ্রবেশ করলাম।
বাড়িতে প্রবেশ করে স্যানটনিক্স আমাকে বললেন, তোমাকে একটা কথা বলি মাইক, স্ত্রীর। প্রতি সর্বদা নজর রাখবে। কখনো স্ত্রীর কোন বিপদ হতে দেবে না।
ইলিয়া বলল, হঠাৎ আপনি আমার বিপদ-আপদের কথা বলছেন কেন?
-কারণ পৃথিবীতে ভাল মানুষ যেমন আছে তেমনি অনেক জঘন্য প্রকৃতির কুৎসিত লোকও ঘুরে বেড়ায়। বাড়িটা তৈরি করতে করতে আমি বুঝতে পেরেছি তোমার চারদিকে জঘন্য প্রকৃতির কিছু লোক সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের দু-একজনকে আমি এই জিপসি একরেই দেখা পেয়েছি।
তারা এখানে এসে বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়াত। নোংরা ধেড়ে ইঁদুর যা করে তেমনি নাক দিয়ে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করত। সেকারণেই আমার মনে হয়েছে তোমাকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত।
এরপরেই প্রসঙ্গ পাল্টে তিনি বললেন, এবারে এসো, সমস্ত বাড়িটা তোমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিই।
গোটা বাড়ি আমরা ঘুরে দেখলাম। কয়েকটা ঘর সম্পূর্ণ খালি রয়েছে। বাকি ঘরগুলো উপযুক্ত ও সৌখিন আসবাবপত্র ও ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। দরজা জানলাতেও বেশ মানানসই পর্দা ঝোলানো হয়েছে।
ইলিয়া বলল, বাড়িটার একটা মনের মত নামকরণ করা বাকি রয়ে গেল।
স্যানটনিক্স বললেন, স্থানীয় লোকেরা তো এই এলাকাটাকে জিপসি একর বলে, তাই না?
আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, নামটা আমার একদম পছন্দ না।
স্যানটনিক্স বললেন, তোমার পছন্দ না হলেও স্থানীয় বাসিন্দারা কিন্তু এলাকাটাকে ওই নামেই ডাকবে।
বাড়ি দেখা শেষ হলে আমরা বৈঠকখানায় এসে বসলাম। গৃহস্থলীর কাজকর্মের জন্য প্রয়োজনীয় দাসদাসী আগামীকাল এসে পৌঁছবে। আমরা সঙ্গে করেই নৈশ আহারের ব্যবস্থা নিয়ে এসেছিলাম।
তিনটে সুদৃশ্য ডিশে তিনজনের খাবার সাজিয়ে দিল ইলিয়া। খাবারের মধ্যে ছিল, ফরাসী রুটি, গলদা চিংড়ির কারি আর নুন মাখানো শুয়োরের মাংস। প্রচুর পরিমাণে পানীয়ও ছিল সঙ্গে।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নানা বিষয়ের গল্পও চলতে লাগল।
ঠিক সেই সময়েই আচম্বিতে ঘটনাটা ঘটে গেল। বাইরে থেকে একটুকরো পাথর কাচের জানলা ভেদ করে আমাদের খাবার টেবিলে এসে পড়ল।
পাথর লেগে একটা গ্লাস ভেঙ্গে গেল। একটুকরো কাচ ছিটকে ইলিয়ার কপালে এসে লাগল।
এই অভাবিত ঘটনায় আমরা হকচকিয়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ফেললাম। ছিটকিনি খুলে জানলা দিয়ে বাইরের চত্বরে গিয়ে পড়লাম। স্যানটনিক্সও আমার অনুসরণ করলেন। আশপাশে খুঁজে কাউকেই পাওয়া গেল না। আমরা উত্তেজিতভাবে ঘরে ফিরে এলাম।