আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে মিঃ স্যানটনিক্সের কথা বলছ?
-হ্যাঁ। আমরা একদিন সেখানে লাঞ্চ খেতে গিয়েছিলাম।
–এরকম ব্যাপারটা সম্ভব হল কি করে? বাড়ির মালিক কি তোমার সম্মায়ের পরিচিত?
–ভদ্রলোকের নাম দমিত্রি কনস্ট্যানটাইন। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের কারো আলাপ পরিচয় ছিল না। গ্রেটাই কি করে সব ব্যবস্থা করেছিল। ফ্র্যাঙ্ককাকাও সঙ্গে ছিলেন।
-তোমার প্রিয়পাত্রী গ্রেটার কথা তো বললে না। সে-ও নিশ্চয় সঙ্গে ছিল?
-না, গ্রেটা আমাদের সঙ্গে যায়নি। আসলে আমার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা করা–মানে আমার সম্মা ঠিক সুনজরে দেখেন না।
-তাতে আশ্চর্য কি। তার কাছে গ্রেটা তো একজন মাইনে করা কর্মচারীর বেশি নয়। তাছাড়া নিশ্চয় সে সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন। বিত্তবানদের পরিবারের একজন হিসেবে গণ্য হবার উপযুক্ত নয়।
-না, মাইনে করা কর্মচারী হলেও আমি তাকে সেভাবে দেখি না। ও আমার বান্ধবী, সহচরী।
-ওসব কথা এখন থাক। তোমার সঙ্গে আমরা দরকারী কথাগুলো সেরে নিই।
–বেশ বলো।
-ভদ্রলোকের কাজের সত্যিই তুলনা হয় না। এককথায় অপূর্ব। তিনি যদি আমাদের জন্যও এমন একটা বাড়ি তৈরি করে দিতেন!
বিভারিয়ার বাড়িটার বিস্তারিত বর্ণনা আমি ইলিয়াকে দিয়েছিলাম। গ্রেটার ব্যবস্থাপনায় সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে সেই অপূর্ব সুন্দর বাড়িটা দেখে এসেছে এবং এমন একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছে।
আমাদের জন্য কথাটা বলে তার এই স্বপ্নের সঙ্গে আমাকেও জড়িয়ে নিয়েছে। ইলিয়ার যে মানসিক পরিবর্তন হয়নি বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হলাম।
ইলিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করল, এতদিন তুমি কি করেছ?
বারবার যা করে থাকি তাই করেছি। একটা নতুন কাজ করেছি, আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
-তোমার মায়ের সম্পর্কে তো এতদিন আমাকে কিছু বলনি।
বলার মতো কি আছে, বল?
–কেন, তোমার মাকে ভালবাস না?
সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারলাম না। পরে ধীরে ধীরে বললাম, ঠিক বলতে পারব না। মানুষ যখন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে তখন ক্রমেই তো জীবনে পিতামাতার প্রয়োজন কমে আসে। তবে এটুকু বলতে পারি, দুনিয়ায় মাকেই যা আমি একটু ভয় পাই। তার কাছে আমার কোন অপকীর্তিই লুকনো থাকে না। মুখ দেখেই ঠিক বুঝে যান।
ইলিয়া হেসে বলল, একজনকে তো জানতে হবে।
আমি ওর ডানহাতের আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বললাম, আচ্ছা ইলিয়া আমার সম্পর্কে তুমি কতটুকু জান?
–তোমার সবটা জানি বলেই তো বিশ্বাস।
–কিন্তু বিশেষ কিছু তো তোমাকে আমি বলিনি।
-তোমার একান্ত ব্যক্তিগত কথা হয়তো কিছু বলনি। কিন্তু তুমি মানুষটা আমার কাছে লুকনো নেই। তোমার কোনটা পছন্দ কোনটা পছন্দ নয় তা আমি ঠিক বুঝতে পারি।
–আমি যে তোমায় ভালবাসি সে কথাও?
–হ্যাঁ। আমার মনের কথা তোমার কাছেও নিশ্চয় লুকনো ছিল না? তাই নয় কি?
–কিন্তু ইলিয়া, একটা বিষয়ে আমি পরিষ্কার নই। দেখ, লণ্ডন শহরের অতি নগণ্য একটা পাড়ায় আমার মা বাস করেন। আমি কে, কিভাবে জীবনযাপন করি সবই তুমি জান। তোমার জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের দুস্তর ব্যবধান। এই পরিস্থিতিতে আমাদের এই সম্পর্কের পরিণতি কি?
–আমাকে কি তুমি একবার তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যেতে পার না?
–তা পারি। কিন্তু তা আমি করব না। দয়া করে তুমি আমাকে নিষ্ঠুর ভেবো না। আসলে আমার ইচ্ছা, দুজন দুজনের জীবনের পরিবেষ্টনী থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জীবনযাপন করব। সম্পূর্ণ নতুন ভাবে আমাদের জীবন গড়ে তুলবে হবে। নাহলে বাঁচতে পারব না আমরা।
–আমার মনের কথাটাই তুমি বলেছ। আমিও তোমাকে একথাই বলতাম। জিপসি একরে আমরা কেবল আমাদেরই জন্য একটা বাড়ি তৈরি করব।
তোমার স্থপতি বন্ধু মিঃ স্যানটনিক্সই সেই বাড়ি তৈরি করবেন। তবে তার আগে আমাদের বিয়েটা হয়ে যাওয়া দরকার।
-হ্যাঁ, আমিও তাই চাই। কিন্তু এর ফলে তোমার কোন অসুবিধা যদি হয়
-অসুবিধার কিছু নেই। আইনের চোখে আমি এখন সাবালিকা। এখন নিজের খেয়াল খুশিমত চলতে আমার কোন বাধা নেই। ভাবছি, আগামী সপ্তাহেই আমাদের বিয়েটা চুকিয়ে ফেলতে পারব।
তবে আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে আমাদের বাস করা হবে না। দুই তরফের কেউই ভালভাবে মেনে নিতে পারবে না।
-তুমি আমাকে কি করতে বলছ?
–বিয়ের কথা আমি আমার আত্মীয় পরিজনদের কিছু বলব না, তুমিও তোমার মাকে কিছু বলবে না। বিয়ে হয়ে যাবার পরে জানাজানি হলে বিশেষ অসুবিধা হবে না। দু চারদিন কিছু হৈ-চৈ হবে এই যা।
একটা কথা মনে পড়ে গেল আমার বললাম, কিন্তু এদিকে যে জিপসি একরের সম্পত্তিটা বিক্রি হয়ে গেছে।
–সে খবর আমার অজানা নয় মশাই। দুচোখে হাসির ছটা বিচ্ছুরিত করে বলল ইলিয়া, জিপসি একরের খোদ মালিকই এখন তোমার সামনে বসে রয়েছে।
.
০৬.
সবুজ মাঠের ওপরে কৃত্রিম ঝরনার পাশে বসে আছি আমরা পাশাপাশি। আশপাশে জোড়ায় জোড়ায় আরো অনেকে বসে আছে। যে যার নিজের স্বপ্ন নিয়েই ব্যস্ত।
এসময় গম্ভীর স্বরে ইলিয়া বলল, মাইক, আজ আমার নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। বক্তব্যটা অবশ্য জিপসি একর বিষয়ে।
আমি বললাম, সম্পত্তিটা কি তুমি তোমার নিজের নামে কিনে নিয়েছ? এতসব করলে কিভাবে, তুমি তো আমাকে তাজ্জব করে দিলে।
-এতে তাজ্জব হবার কি আছে। আমার অ্যাটর্নিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওসব নিয়ে আপাতত তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। এখন আমার কথা শোন।