দিন কয়েক পরে ইলিয়ার কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। সে জানিয়েছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দক্ষিণ ফ্রান্সে বেড়াতে যাচ্ছে, হপ্তা তিনেকের মধ্যেই ফিরে আসবে। আমি যেন বিশেষ চিন্তিত না হই।
ফিরে এসে আবার আমাদের দেখা হবে। সে এবারে একটা জরুরী বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করবে।
ইলিয়ার দর্শনবিহীন তিনটে সপ্তাহ খুব অস্থিরতার মধ্যে কাটল আমার। একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ইলিয়া ও আমার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। এই সম্পর্কের পরিণতি কি তা বুঝতে পারছিলাম না।
ইতিমধ্যে জিপসি একর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সম্পত্তিটা কিনে নিয়েছে লণ্ডনের এক সলিসিটর সংস্থা। তবে কার নির্দেশে কেনা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
সময় যেন কাটতে চাইছিল না। মন ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠেছিল। এই অবস্থায় একদিন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। অনেক দিন তাঁর কাছে যাওয়া হচ্ছিল না।
.
০৪.
আমার মা গত কুড়ি বছর ধরে একটা বাড়িতে বাস করছেন। মায়ের ফ্ল্যাটের নম্বর ছেচল্লিশ। কলিং বেলের বোতাম টিপতে মা নিজেই এসে দরজা খুলে দিলেন। নির্বিকার ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে বললেন, ওঃ তুমি! এসো।
মায়ের পাশ কাটিয়ে আমি ভেতরে ঢুকলাম।
আমার মা স্নেহময়ী। কিন্তু তা কখনো বাইরে প্রকাশ হতে দেননি। আমার অস্থির জীবনধারা তাকে পীড়া দিত, আমাকে শুধরাবার অনেক চেষ্টাই তিনি করেছেন। তবে সে চেষ্টা ফলবতী হয়নি।
এই নিয়েই দুজনের সম্পর্ক একটা অস্বস্তিকর পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভেতরে এসে গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন মা। পরে বললেন, অনেকদিন পরে এলে। এতদিন কি করছিলে?
–এই যা করি, নানান রকম কাজ।
–আমার সঙ্গে শেষবার দেখা হবার পর এর মধ্যে কতগুলো নতুন চাকরি করলে?
আমি মৃদু হেসে বললাম, গোটা পাঁচেক।
-তুমি কি আর সাবালক হবে না?
-আমি তো পূর্ণমাত্রায় সাবালক এখন। আমি আমার নিজের পথ বেছে নিয়েছি। তা তুমি কেমন আছ?
–আমার অবস্থাও তোমারই মত, কোন পরিবর্তন নেই।
একটু থেমে হঠাৎ সুর পাল্টে মা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার হঠাৎ এভাবে হাজির হবার কি কারণ ঘটল?
-তোমার কাছে কি বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আসতে হবে?
–তোমাকে তো তাই দেখে আসছি।
-আচ্ছা, মা আমি এই দুনিয়াটাকে বুঝতে জানতে চাই, এতে তোমার এত আপত্তি কেন, বলতো?
–একটার পর একটা চাকরি ছাড়াই কি তোমার পৃথিবীকে জানা বোঝা?
–তাই তো।
–এতে তুমি কতটা সফল হবে আমার মাথায় ঢোকে না।
–আমি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পথেই তো এগিয়ে চলেছি।
এরপর মা দু পেয়ালা কফি নিয়ে এলেন। প্লেটে করে আমাকে হাতে তৈরি কেক দিলেন। আমি আর মা মুখোমুখি বসলাম।
মা বললেন, এবারে তোমাকে কিছুটা অন্যরকম লাগছে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম। মা বললেন, কি এমন ব্যাপার ঘটল, বলতো?
–কিছুই ঘটেনি।
–কিন্তু তোমাকে একটু উত্তেজিত লাগছে।
–হ্যাঁ, তুমি তো আমার সবকিছুই জেনে বসে আছ।
–না, তা জানি না। তোমার জীবনযাপন এমন যে আমার পক্ষে কিছুই জানা সম্ভব না। কিন্তু এবারে ব্যাপারটা কি? তোমার কোন বান্ধবী
আমি হেসে বললাম, তুমি দেখছি কাছাকাছি চলে এসেছ!
মেয়েটি কেমন?
–ঠিক আমার মনের মত।
–তাহলে তাকে কি আমার কাছে নিয়ে আসছ?
–না।
–কেন, পাছে আমি তোমায় নিষেধ করি?
–তোমার ওজর আপত্তি কি আমি গ্রাহ্য করি?
তা না করলেও, ভেতরে একটা নাড়া তো পাবেই। মেয়েটা কি কোনভাবে তোমাকে হাত করে ফেলেছে?
–ওসব কিছুই নয় মা। ওকে দেখলে তুমি খুশি হবে।
–তুমি তাহলে এখন আমার কাছে কি চাও?
–আমার কিছু অর্থের প্রয়োজন।
–কেন, ওই মেয়েটার পেছনে খরচ করবে বলে?
–না, বিয়ের জন্য আমাকে একটা ভাল পোশাক কিনতে হবে।
–তাহলে ওই মেয়েটিকেই বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছ?
–তার তরফ থেকে যদি কোন আপত্তি না থাকে।
মায়ের মুখের ভাব হঠাৎ পাল্টে গেল। কঠিন ভাবটা সরে গেল। বিচলিত কণ্ঠে বললেন, খোকা, আমাকে যদি সব খুলে বলতে!
তারপর আক্ষেপের সুরে বলতে লাগলেন, আমি বুঝতে পারছি, সাংঘাতিক কোন বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছ। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। এই আশঙ্কাটাই আমার ছিল, পাত্রী নির্বাচনের ব্যাপারে তুমি ঠিক ভুল করে বসবে।
–আমার পাত্রী নির্বাচনে ভুল হয়েছে–তোমার কাছে আসাই আমার ভুল হয়েছে।
আমার মাথার ভেতরে যেন হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর কোন কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পথে নেমে পড়লাম।
.
০৫.
বাসায় এসেই অ্যান্টিবাস থেকে পাঠানো ইলিয়ার একটা তার পেলাম। ছোট্ট করে জানিয়েছে–
আগামীকাল বেলা সাড়ে চারটের সময় নির্দিষ্ট জায়গায় তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকব।
রিজেন্ট পার্কের সেই পুরনো জায়গাতেই আমাদের দেখা হল। যেন একযুগ পরে ওকে দেখলাম।
অনেক কথা জমে ছিল। কিন্তু বলতে গিয়ে যেন বাধ বাধ ঠেকতে লাগল। মনে হল, ইতিমধ্যে ইলিয়া কি অনেক পাল্টে গেছে? ওর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দক্ষিণ ফ্রান্সের কোন শহরে এতদিন কাটিয়ে এসেছে, তার মধ্যে কি ধরনের পরিবর্তন সম্ভব? কিন্তু আমি তো জানি ইলিয়া আমাকে ভালবাসে।
আমাকে ইতস্ততঃ করতে দেখে ইলিয়াই প্রথম কথা বলল, তোমার সেই স্থপতি বন্ধু যে বাড়িটা তৈরি করেছে বলেছিলে, এবারে আমি সেটা দেখে এসেছি।