একটু চুপ করে থেকে কি ভাবল ইলিয়া। পরে আবার বলতে লাগল।
ওর জন্যই আমি খানিকটা হাঁপ ছাড়তে পেরেছি। মাঝে মাঝে মর্জিমাফিক ঘুরে বেড়াতে পারি। আমার জন্য বেচারীকে মিথ্যেও বলতে হয় ঝুড়ি ঝুড়ি। জিপসি একরে আসার সুযোগ পেয়েছি ওরই জন্যে।
আমার সৎমা এখন প্যারিসে। আমি যে কদিন লণ্ডনে থাকব, আমার দেখাশোনা করবার জন্য গ্রেটাও থাকবে আমার সঙ্গে।
সপ্তাহে তিনটে করে চিঠি সৎমাকে লিখতে হয়। আমি যখন লণ্ডনের বাইরে যাই, দু-তিনখানা চিঠি লিখে গ্রেটার কাছে রেখে আসি। ও কয়েক দিন অন্তর সেগুলো ডাকে পাঠিয়ে দেয়। সত্য বুঝতে পারেন আমি লণ্ডনেই আছি।
মৃদু হেসে আমি বলি, হঠাৎ করে এই জিপসি একরে আসতে গেলে কেন?
–আমি আর গ্রেটা মিলে ঠিক করেছিলাম। সত্যি বন্ধু হিসেবে গ্রেটার তুলনা হয় না। আমি সকৌতুকে জিজ্ঞেস করি, তোমার এই বন্ধুটি দেখতে কেমন?
–গ্রেটা সুন্দরী। দেহের গড়নও চমৎকার। তার ওপরে অসম্ভব বুদ্ধিমতী। ইচ্ছে করলে গোটা পৃথিবী গ্রেটা জয় করে নিতে পারে। তুমিও তাকে পছন্দ না করে পারবে না।
আমি বিনীত কণ্ঠে বলি, মেয়েদের বেশি বুদ্ধি থাকাটা আমি হজম করতে পারি না। তাছাড়া গ্রেটা তোমার এত বেশি প্রিয়পাত্র যে আমি হয়তো তাকে হিংসে না করে পারব না।
–গ্রেটাকে তুমি হিংসে করো না। ও আসার পর থেকে আমার জীবনটা স্বাভাবিক হতে পেরেছে।
–কিন্তু গ্রেটা তোমাকে এখানে আসার পরামর্শ কেন দিল তা বুঝতে পারছি না। জিপসি একরে দর্শনীয় কিছুতো নেই। ব্যাপারটা খুবই রহস্যময় ঠেকছে।
–সেটা একটা গোপনীয় বিষয়, আমি আর গ্রেটাই কেবল জানি।
–আচ্ছা, আমাদের এই দেখা-সাক্ষাতের কথাও কি গ্রেটা জানে?
–জানে, তবে বন্ধুটি কে বা তার পরিচয় কি সে বিষয়ে কিছু জানে না। আমি সুখী, এতে সে আনন্দিত।
এরপর সপ্তাহখানেক ইলিয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তার সম্মা প্যারিস থেকে ফিরে এসেছেন। তার সঙ্গে আর একজনও এসেছেন, ইলিয়া তাকে ফ্র্যাঙ্ককাকা বলে ডাকে।
কয়েকদিন পরেই লণ্ডনে ইলিয়ার জন্মদিন পালিত হবে। সেই উপলক্ষ্যে সকলেই নাকি খুব
একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। গ্রেটা নামের মেয়েটি ইলিয়ার জীবনের অনেকখানি দখল করে নিয়েছে। তার প্রশংসায় সর্বদাই সে পঞ্চমুখ। কেবল তাই নয় অতিমাত্রায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কার্পণ্য করে না।
ইলিয়ার বিমাতা ও অন্যান্য অভিভাবকরা তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব গ্রেটার ওপরই ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন।
তার ফ্র্যাঙ্ককাকার বিষয়ে ইলিয়া জানিয়েছিল, তিনি ঠিক তার কাকা নন–পিসেমশাই। তার সঙ্গে রক্তসম্পর্ক নেই।
অদ্ভুত প্রকৃতির এই মানুষটা সর্বদা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। কোন কাজ করেন না, কিন্তু খরচের বেলা বেহিসাবী। ইলিয়ার ধারণা তার কাকাটি সঙ্গী হিসেবে চমৎকার। তবে মাঝে মাঝে যেন কেমন হয়ে যান
দেখাসাক্ষাতের মধ্য দিয়ে আমরা দুজন দুজনের অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, ইলিয়া কখনো তার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য উৎসাহ দেখায়নি।
ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। একদিন আমি নিজে থেকেই কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
ইলিয়া মৃদু হেসে বলল, না, মাইক, এখনই তাদের সঙ্গে তোমার পরিচয় হোক, আমি তা চাই না। কথাটা শুনে স্বাভাবিকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। আমার আত্মমর্যাদায় আঘাত লেগেছিল।
ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলেছিলাম, আমি অবশ্য খুবই সাধারণ শ্রেণীর মানুষ, নিতান্তই নগণ্য….
ইলিয়া বলল, না মাইক, আমি সেকথা বলতে চাইনি। আসলে আমাদের সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে তখনই সকলে মিলে নানাভাবে গণ্ডগোল পাকাবার চেষ্টা করবে। সেটা আমার বাঞ্ছিত নয়।
আমি বললাম, আমার যেন মনে হচ্ছে, কেমন একটা লুকোচুরি খেলায় জড়িয়ে পড়েছি।
ইলিয়া বলল, আমার বয়স একুশ হতে চলল। একুশে পড়লেই আমি পছন্দমত আমার সঙ্গী নির্বাচন করার আইনসিদ্ধ অধিকার লাভ করব।
কেউই তখন আমার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। আমার কথা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছ।
একুশ বছরে পড়বার আগে সেকারণেই একটা গণ্ডগোল বাধাতে চাইছি না। তাহলে হয়তো আমাকে দূরে এমন কোথাও কৌশল করে পাঠিয়ে দেবে যে তোমার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখাই সম্ভব হবে না। কটাদিন একটু ধৈর্য ধর মাইক…
–তোমার অসুবিধাটা আমি অনুধাবন করতে পারছি। তবে আমি এভাবে আড়ালে থাকার পক্ষপাতী নই বললাম।
আমাদের কথাবার্তার ফাঁকে জিপসি একরের প্রসঙ্গও এসে পড়ত। অবশ্য ইলিয়া নিজেই উত্থাপন করত।
কেমন স্বপ্নবিষ্ট গলায় বলে উঠত, আচ্ছা আমরা যদি জিপসি একর জায়গাটা কিনে নিই। কেমন হয়? পরে সেখানে একটা বাড়ি তুলব
ইলিয়ার কাছে স্যানটনিক্সের অনেক গল্পই করেছিলাম। আমি বুঝতে পারতাম না তার বাড়ি তৈরির কল্পনার সঙ্গে তার নামও জড়িয়ে ছিল কিনা।
ইতিমধ্যে আমি ইলিয়ার জন্য একটা সবুজ আংটি কিনে রেখেছিলাম। সেটা আমার তরফ থেকে তার জন্মদিনের প্রীতি উপহার স্বরূপ তুলে দিলাম। আনন্দে ইলিয়ার দুচোখ ঝকঝক করে উঠল।
বলল, জন্মদিনে অনেক উপহারই আমি পেয়েছি। তবে এটাই সবচেয়ে সুন্দর আর মূল্যবান।
ইলিয়া দু-একটা গয়না যা পরে থাকত, তা সবই মূল্যবান হীরে-জহরত বসানো। কিন্তু লক্ষ্য করেছিলাম আমার আংটিটা পেয়ে সে অকৃত্রিম আনন্দ প্রকাশ করেছিল।