তারপর জিমকে বলতে শোনা গেল–দেখ, আমার একটা ফোন এসেছে। একটু অপেক্ষা করো।
পরমুহূর্তেই হেলেনার রিসিভারে জিমের কণ্ঠস্বর সরাসরি শোনা গেল।
-হ্যালো। হ্যালো।
কিন্তু হেলেনা উত্তর দিলো না। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো সে। রাগে উত্তেজনায় তার মুখ থমথম করছিল তখন। নিউমার্কেটের একটা দোকান থেকে ফোন করেছিল সে। ফোন চার্জ মিটিয়ে দিয়ে তেমনই উত্তেজিত হয়ে সে বেরিয়ে আসতে গেল।
দোকানের মালিক অবাক চোখে নিরীক্ষণ করছিল তাকে। এবার তাকে জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার? কি কারণে তার অমন রাগের কারণ ঘটলো?
এবারও হেলেনা কোন উত্তর দিলো না। কারো জন্যে অপেক্ষা করার সময় নেই তার কাছে। কোন কিছুর জন্য এখন এখানে দাঁড়াবার প্রয়োজন নেই।
বাইরে বেরিয়ে এসে তেমনি উত্তেজিত ভাবে এবং দ্রুতগতিতে সে পথ চলছিল। তার দুচোখে অবিশ্বাসের ছায়া। এমন একটা কিছু যে ঘটবে ভাবতেও পারেনি সে। একটা সিগারেটের দোকানের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। দোকানী তার পোডড়া চেহারা দেখে অবাক চোখে তাকালো। হেলেনার চোখের ভরা জল তখন আর কোন বাধা মানলো না। দুচোখের কোল ছাপিয়ে জলের ধারা নামলো। দুহাতে মুখ ঢেকে আবার তাড়াতাড়ি চলতে শুরু করল।
তারপর থেকে হেলেনা প্রায় সকাল সন্ধ্যে বাইরে কাটিয়ে দিতে থাকলো। কখনো বোটানিক্যাল গার্ডেন, কখনো জুওলজিক্যাল গার্ডেন। তার এই পরিবর্তন নিজের কাছেই কেমন যেন খাপছাড়া লাগে। তবে জিম তার ব্যাপারে কদাচিৎ মাথা ঘামিয়ে থাকে। আজও সে হেলেনার হঠাৎ এই পরিবর্তনে কোন কৌতূহল প্রকাশ করলো না। ওদিকে হেলেনা তখন ভীষণ ব্যস্ততায় মনের অসুখ সারাচ্ছে। বন্ধুদের কাছে তাদের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের সব গল্প, সব অহঙ্কার ধুলোয় মিশে যাওয়ার কথা চিন্তা করছে। এবং এই সব কথা চিন্তা করে অত্যন্ত হতাশ এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে সে।
জিমের ওপর এখন তার যত না রাগ, তার চেয়ে বেশি রাগ গিয়ে পড়লো বন্ধুদের ওপর। কারণ কথাটা জানাজানি হয়ে গেল তারা কাকের মতো কা কা রব তুলে চীৎকার করে দেবে আর নিন্দায় সরব হয়ে উঠবে। তারা বলবে, হেলেনার স্বামী আবার তার আগের স্বভাবে ফিরে গেছে। হয়তো এটাই তার পথ এবং সোজা কথা হলো হেলেনা বড্ড বেশী অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলো।
এসব কথা তাদের কাছে জানাজানি হওয়ার মুহূর্ত মাত্র তাকে নিয়ে পূরণ করা সেই সব সরস গল্পগুলো আবার সকলের মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকবে। হেলেনার চোখের সামনে হয়তো তার কপট সহানুভূতি জানাতে বসবে। মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাসবে। মনে মনে কৌতুক অনুভব করবে তারা। তাকে তার অহঙ্কারের কি ফল হতে পারে সেটা স্মরণ করিয়ে দেবে। একজনের জীবনে যেটা ব্যর্থতা, অপরের কাছে সেটা আনন্দের উপভোগের সামিল হয়ে দাঁড়ায়। আর হেলেনার এই ব্যর্থতা স্বভাবতই তাদের কাছে উপভোগ্য। মানুষ বড় বিচিত্র আর বিচিত্র তাদের মন।
আবার শুরু করে। হয় বাড়িতে সেই আগের মতো সন্দেহ। সেইরকম উত্তেজনা। একই বাড়িতে একই ঘরে থেকেও দুজনের মধ্যে রচনা হয় ব্যবধানের প্রাচীর। বেড়াল ইঁদুরের খেলা খেলবে দুজনে। জিমকে খুশী খুশী দেখাবে। কোন পরিবর্তন দেখা যাবে না। সে জানে এবং সবসময় তার ধারণা এইরকমই যে হেলেনা তার কোন খবরই রাখে না। রাখার প্রয়োজন মনে মনে করে না। অতএব তার এই পরিবর্তনের কথা সে এক বিন্দুবিসর্গ জানতে পারবে না। রোজকার অভ্যাস মতো প্রতি সন্ধ্যায় বাড়িতে গিয়ে জিম যখন তাকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে উচ্চ চুম্বনের আলপনা এঁকে দেবে–তখন বাধ্য হয়েই হেলেনাকে মিথ্যে ভান করতে হবে না। যেন সে জিমের বর্তমান স্বভাবের কথা আদৌ জানে না। জানে না সোফিয়া নামে এক তরুণীর সঙ্গে জিমের নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে। এই মিথ্যে অভিনয় করতে গিয়ে তার বুক ফেটে যাবে কিন্তু মুখ ফুটে কোন কথা বলতে পারবে না। এমনকি চোখের কোণে উদগত অশ্রুরেখাকে অতিকষ্টে সংবরণ করে ঠোঁটের কোণে সে ফুটিয়ে তুলবে হালকা হাসির ইশারা।
এই ভাবেই জিম তাকে ফেলে রেখে সিনেমা দেখতে গেলে অসভ্য হয়ে উঠবে সে। আস্তে আস্তে একদিন সে পাগল হয়ে উঠবে। আর জিমেরই বা কি চতুর কথা বলার কৌশল। জিম বেশ ভালভাবেই জানে, হেলেনা সিনেমা দেখে না। তাই সে বুদ্ধি করে তার কাছে সিনেমা যাওয়ার গল্পটা ফেঁদে বসে রোজ। কিন্তু এবার সে আর সহ্য করবে না। এবার সে কেবলই প্রবঞ্চিত হবে না। আর তার খেলার পুতুল হয়ে বসে থাকবে না। হেলেনা কথাগুলো খুব মন দিয়ে ভাবলো। সোফিয়া নামটা গলার কাছে আটকে গেছে।
তরুণী সেফিয়া। হ্যাঁ, অবশ্যই সে তরুণী। এ ধরনের মেয়েরা সবক্ষেত্রে অল্প বয়স্ক তরুণী হয়ে থাকে। তরুণী এবং সহানুভূতিহীন।
ক্ষণিকের সুখ-তৃপ্তির জন্যে সুখসংসার ভেঙে তছনছ করে দিতে কোন দ্বিধা নেই, কোন সংকোচ নেই তাদের। সম্ভবতঃ এই অঞ্চলেই থাকে। নামটা খুব চেনা চেনা। সোফিয়া? নামটা যে সে এর আগে শুনেছে এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত।
জিম ফোনে লোকটির নাম বলেছিল। হেলেনা জানে আর কজন লোক সোফিয়াকে চেনে। জিম কি এতই নির্লজ্জ? এতই বেহায়া? আবার হয়তো এমনও হতে পারে, আজ সে আর কাউকে পরোয়া করে না। সম্ভবত সে এখন চায় হেলেনা জানুক তার গোপন অভিসারের কথা। যাতে সে নিজে থেকেই ছেড়ে চলে যায়।