লেখার টেবিলের ওপর ধুলো জমা ডানিং-এর ব্যাগটা পড়েছিল। ছোট আকারের একটা লেখার কাগজ তার ভেতরে ছিল, একটা হাল্কা ধরনের কাগজ তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে উড়তে শুরু করলো। জানলাটা সঠিক সময়ে হ্যারিংটন বন্ধ না করলে তা চলে যেত। তিনি কাগজটা তুলে নিলেন। বলেন, যে ধরনের কাগজ আমার ভাইকে দেওয়া হয়েছিল সেটা এইরকমই। দেখুন, ডানিং বিষয়টা আপনার কাছে খুব গুরুত্ব পেতে পারে।
দুজনে খানিকক্ষণ ধরে আলোচনা করল, খুব যত্ন সহকারে সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করল কাগজটা। উভয়ের এটাই মনে হলো হেনরি সঠিক বলেছে। রুশিক ভাষাতেই কাগজে লেখা আছে যা তাদের অজানা। ঐ কাগজে যা অমঙ্গল লুকিয়ে আছে তা হয়ত বাস্তবায়িত হয়ে যেতে পারে; এই ভয়ে তা নকল করতে ইতস্ততঃ করলেন। ঐ টুকরো কাগজে কি খবর ছিল তা জানা অসম্ভব হলো। আর হেনরি হ্যারিংটন ও ডানিং–উভয়েরই এই ধারণা হলো কাগজটা যার কাছে রইবে তারই মঙ্গল হওয়ার কথাই নয়। সেইকারণে সেটা যথাস্থানেই ফেরত দেওয়া হবে এবং নিজের হাতেই নিরাপদে কাজটা করা সম্ভব। এই জায়গায় কার্সওয়েল ডানিংকে দেখেছেন। ডানিং-এর চেহারাটা বদলে ফেলার জন্য প্রথমেই তাকে দাঁড়ি কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু যদি তার আগে বিপদ চলে আসে? তবে বিপদটাকে এড়ান যাবে কারণ পরের কনসার্টের তারিখ তার অজানা নয়। তার ভাইয়ের ওপর প্রোগ্রামের কালো মার্কা দেওয়া হয় ১৮ই জুনের কনসার্টের। আর মৃত্যু হয় ১৮ই সেপ্টেম্বর। ডানিং স্মরণ করিয়ে দেয় ট্রামে, তিন মাস কথাটা লেখা ছিল। পরক্ষণে কঠিন হাসি হেসে বললেন, আমার বিলটাও তিনি মাসেরই হতে পারে। –তবে তা আমি ডায়েরি থেকেই দেখে নিচ্ছি।-২৩শে এপ্রিল ছিল মিউজিয়ামের তারিখ ও হিসেব করে আমরা পাই ২৩শে জুলাই। তবে ভাবুন আপনার ভাইয়ের অশান্তিটা কোন পথে চলেছিল তা বলতে পারলে অনেক সুবিধা হয়।
তা অবশ্য ঠিক। জানেন, ভাইয়ের কাছে দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল, যখন তার কাছে কেউ থাকত না, তার মনে হত কোনো লোক তাকে লক্ষ্য করছে। কয়েক দিন পরে তার ঘরে আমি শুলে সে স্বস্তি পেল। তবুও সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অনেক কথা বলত। হা কিসের ওপর সে কথা বলত? কিন্তু সমস্যাটা না মিটলে এর ওপর কি কিছু বলা উচিত? মনে হয় অনুচিত। এটাই শুধু বলতে পারি এই কয়েক সপ্তাহে দুটো জিনিস ডাকযোগের মাধ্যমে তাঁর নিকটে আসে, লণ্ডনের পোস্ট অফিসের ছাপ দুটোতেই। বেউকের উডকাট ছবি একটা, কোন বই থেকে অযত্নে ছিঁড়ে নেওয়া, ছবিটা হলো একজন লোক পূর্ণিমা চাঁদনী রাতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে আর ভীষণ আকৃতির এক দৈত্য তাকে ফলো করছে। এনলেন্ট ম্যারিনার থেকে নেওয়া কয়েকটা লাইন তার তলায়
পথে যেতে যেতে
ফিরে দেখে না সে একবার,
জানে মনে, এক বিকট দৈত্য
পিছু নিয়ে আছে ঠিক তার
দ্বিতীয় বস্তুটি ছিল একটা ক্যালেণ্ডার, ব্যবসায়ীরা যেরকম ক্যালেণ্ডার অনেক সময় পাঠায়। সেইকারণে এই ঘটনাকে তেমন পাত্তা দেয়নি, তবে তার মৃত্যুর পরে আমি সেটা লক্ষ্য করেছিলাম। ১৮ই সেপ্টেম্বরের পর থেকে সবকিছু ছেঁড়া দেখেছিলাম। আপনি শুনলে হয়ত অবাক হবেন যেদিন সন্ধ্যেয় তার মৃত্যু হয়েছিল ঐদিন তিনি একা বেরিয়েছিলেন। কিন্তু এটা ঠিক ভাবেই বলা যায় যে তার জীবনের শেষ দশ দিন তার মনে হয়নি কেউ তার পিছু নিচ্ছিল।
এইভাবেই আলোচনা শেষ হয়। কার্সওয়েলের একজন প্রতিবেশীকে হেনরি হ্যারিংটন চিনতেন, তাঁর মনে হলো তিনি কার্সওয়েলের গতিবিধির ওপর দৃষ্টি রাখার একটা উপায় পেয়েছেন। অপর দিকে ডানিং-এর কাজই হবে প্রতি মুহূর্তে কার্সওয়েলের সাথে মোকাবিলা করার জন্যে তৈরি থাকা, কিন্তু কাগজটা নিরাপদ কোন জায়গায় রাখা যা কার্সওয়েলের পক্ষে পাওয়ার অসুবিধা হবে না।
দুজনে আলাদা হয়ে গেলেন। পরবর্তী কয়েকটা সপ্তাহে ডানিং-এর মানসিক চাপের সৃষ্টি হলো। তার চারপাশে কেউ রইল না যে, তাকে কোনো পরামর্শ দিতে পারে, এছাড়াও তার নিজের পক্ষ থেকে কোনো উৎসাহই বাকি রইল না। হ্যাঁরিংটনের কাছ থেকে কোনো নির্দেশের জন্যে মে, জুন, জুলাই মাসের প্রথম কটা দিন ডানিং-এর অতীব দুশ্চিন্তায় সময় কাটল। সেই সময়ে কার্সওয়েল লাফোর্ডে নীরব রইলেন।
অবশেষে যে তারিখকে তিনি শেষ দিন হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন তার সপ্তাহখানেক পূর্বে একটা টেলিগ্রাম এল: ৮ বৃহস্পতিবার রাতে বোট ট্রেনে যাত্রা করছে। লক্ষ্য রাখবেন আপনার কাছে আজ রাতে যাচ্ছি। হ্যারিংটন।
ঠিক সময়ে হ্যারিংটন এলেন। উভয়ে পরামর্শ করলেন, ভিক্টোরিয়ায় কার্সওয়েলকে হ্যারিংটন লক্ষ্য করবেন, আর ক্রয়ডনে ডানিংকে। এছাড়া একটা নির্দিষ্ট নামে হ্যারিংটন ডানিংকে ডাকবেন ঠিক হলো। যতটা সম্ভব হ্যারিংটন ছদ্মবেশ ধরবেন, তার জিনিসপত্রে কোনো নাম লেখা থাকবে না। আর কাগজটা তিনি নিশ্চয়ই সঙ্গে রাখবেন।
ক্রয়ডন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ডানিং প্রচণ্ড উৎকণ্ঠার সাথে অপেক্ষা করতে লাগলেন, যা সত্যি বর্ণনা করা যায় না। তাছাড়া কয়েকদিনের মেঘলা আকাশ একটু পরিষ্কার হওয়ায় বিপদ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তবে আশঙ্কার লক্ষণ তো স্বস্তি, আর কার্সওয়েল তাকে এ যাত্রায় এড়িয়ে গেলে আর কোনো আশা থাকবে না, এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যে নেই তা নয়। তবে এই যাওয়ার খবরটা যে এসেছে তাও যে কোনো বদ মতলব না, তা কে জানে। তিনি এই যে মিনিট কুড়ি ধরে প্ল্যাটফর্মে হাঁটাচলা করছে এবং সব কুলিকে বোট ট্রেনের সম্বন্ধে প্রশ্ন করছেন এটা খুবই বিরক্তিকর। অবশেষে ট্রেন এল, হ্যারিংটনকে জানলার কাছে দেখা গেল। তবে উভয়ই যে উভয়কে চেনে তা প্রকাশ করা যাবে না, তাই ডানিং উঠলেন গাড়ির দূরবর্তী প্রান্তে আর অল্প অল্প করে কামরার সেইখানে যেখানে হ্যারিংটন ও কার্সওয়েল বসে আছেন। অল্প খুশীও হলেন যে গাড়িতে তেমন লোক নেই।