তাই হে এরকুল পোয়ারো, পার্কার পাইন, মিস মারপল এবং অন্যান্য গোয়েন্দাবৃন্দ, প্রায় ফুরিয়ে আসা এই বিংশ শতাব্দীর এই শেষ শতকে যখন পৃথিবী ক্রমশঃ ছোট হয়ে যাচ্ছে, বিস্মরণের পক্ষে যখন গোয়েন্দারা আর মত্ত মাতাল অভিসারে ব্যস্ত থাকে না বুদ্ধির লড়াইতে আততায়ীকে আক্রমণে, যখন ফিঙ্গার প্রিন্ট কমপিউটার ক্রিমিনোলজির সাহায্যে অতিসহজেই চিহ্নিত করা যাচ্ছে একজন অপরাধীকে আর ঘোষণা করা হচ্ছে সে কোন খুন ধর্ষণের অন্তরালে আছে মনস্তাত্ত্বিক আঘাত তখন বোধ হয় এরকুল পোয়ারোর ছুটি নেবার সময় হয়ে এলো। তাকে তো এখন অসামরিক যুদ্ধে নামতে হবে সুপারম্যানের সঙ্গে। সে কি লড়াই করতে পারবে ব্যাটম্যানের সঙ্গে খালি হাতে? ফানটাসির জগতে সে যে অচল তার ক্ষুরধার বুদ্ধি নিয়ে সে কোনদিনই সুপারসনিক বিমানে এগিয়ে যেতে পারবে না। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী করতে পারবে না অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে। তাই বোধহয় বর্তমান প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের কাজে আগাথা ক্রিস্টি আর আগের মতো এতখানি জনপ্রিয় নন। যদিও আমার বিশ্বাস রাখি যে, আগাথা সাহিত্যের মৃত্যু নেই। বহমান সমুদ্র প্রবাহের মত, ধীর ভাস্বর আকাশের দীপ্তমান রশ্মির মত আগাথা ক্রিস্টি চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবেন আমাদের মনের আকাশে। যতদিন সভ্যতা থাকবে, চন্দ্র সূর্য তারা থাকবে ততদিন আগাথার মৃত্যু নেই। সত্তায় এগিয়ে যাবেন তার ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে। সে লক্ষ্য হলো সফলতার আনন্দের আশা এবং সকলের এই বিশ্বাস আমরা রাখতে পারি।
আগাথা সাহিত্য সম্বন্ধে কয়েকজনের অভিমত–
আগাথা ক্রিস্টির রচনাবলীকে প্রথমে অনেকেই মহৎ সাহিত্যের সংজ্ঞা দিতে চান নি। বৃটিশ সাহিত্যের উন্মাসিক সমার্লোচকের এই সব রহস্য কাহিনীর কপালে ব্রাত্যের টিকা পরিয়ে ছিলেন যখন আগাথার জনপ্রিয়তা স্বর্ণশিখরে উপনীত হয়। মাসের পর মাস ধরে তার লেখা নাটক লণ্ডনের অভিজাত পাড়াতে দর্শক প্রেক্ষাগৃহ পরিপূর্ণ হয়ে থাকে, যখন বেস্ট সেলার তালিকায় দশটির মধ্যে ছটিই থাকে আগাথার নাম তখন মতবাদ পাল্টাতে বাধ্য হয়ে ছিলেন তারা।
ডগলাস হার্ভের মত এক দুদে বৃটিশ সমার্লোচক মন্তব্য করেছিলেন লণ্ডন টাইমসের পাতায়–যদিও আগাথা ক্রিস্টি রহস্য সাহিত্যের অঙ্গন উজ্জ্বল তারা। কিন্তু সামাজিক রচনা ক্ষেত্র ও তার মুন্সিয়ানা আমাদের বিস্মিত করে। অতি সামান্য তুচ্ছ ঘটনাকে অবলম্বন করে তিনি যে বৃহৎ উপন্যাস সৃষ্টি করেন, তার প্রতিটি ছত্রে মহতী লেখিকার প্রবল জীবনবোধ এবং জ্ঞান পিপাসার পরিচয় আমাদের মুগ্ধ বিস্ময়ে আবিষ্ট করে দেয়।
ম্যানচেষ্টার গার্ডেনের পাতায় প্রখ্যাত গ্রন্থসমার্লোচক স্যার ডরোথি স্মিথ এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে–আগাথা ক্রিস্টির লেখা দি এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবারেকে আমরা অনায়াসে এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসাবে অ্যাখ্যা দিতে পারি। এই কাহিনীর মধ্যে মানব রহস্য অন্বেষণে লেখিকার নিরন্তর পদচারণা আমাদের বিস্মিত করে। কত সহজে বিভিন্ন মানুষে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা লোভ, কামনা, বাসনার ছবি এঁকেছেন, তা অবাক হয়ে দেখতে হয়।
পরিশেষে তার রহস্য ছিন্ন করা একান্ত ভঙ্গিমাটি আমাদের অবাক বিস্মিত করে দেয় এই কারণে যে, বিনা রক্তপাতে, বিনা বুলেট আক্রমণে এরকুল পোয়ারো নিজের প্রচণ্ড বুদ্ধিদীপ্তকে পাথেয় করে সম্ভাব্য আততায়ীকে চিহ্নিত করেছেন এবং তাকে উপযুক্ত শাস্তি বিধানে কুণ্ঠা বোধ করেননি। এখানেই লেখিকার মুন্সিয়ানা।
শুধুমাত্র বৃটিশ সাহিত্যের সমার্লোচকরাই নয়, আগাথা ক্রিস্টির রচনা পৃথীবীর যে সমস্ত ভাষাতে অনূদিত হয়েছিলো সেই সব ভাষার প্রখ্যাত সমার্লোচকরা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন আগাথার অনন্যসাধণ কৃতিত্ব। আফ্রিকা থেকে জাপান, নিউফাউল্যাণ্ড থেকে ভারতবর্ষ, পাকিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া সর্বত্রই সমানভাবে পঠিত এবং রচনারাজি। এখানে ভেঙে গেছে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিশ্বের আবরণ। প্রথম দুনিয়া এসে হাত মিলিয়েছে তৃতীয় দুনিয়ার সাথে। মাল্টিমিলিয়নের সাথে একই ডিনারে পাশাপাশি বসে আগাথার রচনা পাঠ করে দরিদ্রতম ব্যক্তি। সাহিত্য যে সামাজিক সমস্ত বাধাকে এক নিমেষে অতিক্রম করতে পারে আগাথা ক্রিস্টির রচনাবলী হলো তারই উজ্জ্বলতম নিদর্শন।
শুধু কি তাই? রহস্য সাহিত্যকে তিনি আপন রচনার ঐশ্বর্যে নিশ্চিন্ত করেছেন চিরায়ত সাহিত্যের অঙ্গনে, এটাই তার অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব–আজ উন্মাসিক পাঠক-পাঠিকারাও অনায়াসে অবগাহন করেন ক্রাইম লিটারেচারের পাতায়, অনুভব করেন এক অনাস্বাদিত আনন্দ-এর অন্তরালে আছে রহস্যসম্রাজ্ঞীর অপূর্ব লৈখনী শৈলী। আগাথা যে শুধু ক্রিমিনাল কাহিনীকে উদ্ভাস করেছেন তাই নয়, তার কপালে লেখন করেছেন বিশ্ববিজয়ের জয়টীকা সৃষ্টি করেছেন লক্ষ লক্ষ মুগ্ধ পাঠক-পাঠিকা। তাই টুপি খুলে কুর্নিশ করতে হয় বিশ্বের রহস্যকাহিনীর নায়িকা আগাথা ক্রিস্টিকে।