হে পাঠক-পাঠিকা, এবার সত্যি সত্যি বোধহয় বিদায় নিতে হবে আপনাদের স্নেহের দরবার থেকে। যদিও জানি স্লিপিং মার্ডার বা ঘুমন্ত মৃত্যু এসে যখন গ্রাস করবে আপনাদের; তখনও আপনারা অসহায় আর্তনাদে তাকিয়ে থাকবেন মিস মারপল, পার্কার পাইন অথবা এরকুল পোয়ারোর দিকে।
শুধু কি রহস্য সাহিত্য লেখার জন্যে জন্ম হয়েছে আমার। বোধহয় তা নয়। আমর এই আত্মজীবনী এবং অপর একটি উপন্যাস কাম টেল মি হাউ ইউ লিভ-এর রোমান্টিকতা অনেকের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। চুপি চুপি একটি কথা জানিয়ে রাখি, এইসব লেখনীর অন্তরালে আছে আমার প্রত্নতাত্ত্বিক স্বামী ম্যাক্স ম্যালোয়ানের অবদান। ম্যাক্সের মত স্বামী না পেলে এত সুন্দর লেখা লিখতে পারতাম না। কেননা ম্যাক্সই তো আমার দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমার জীবনে চলার পথকে অনেকখানি মসৃণ করে দিয়েছিলো।
আর একটি কথাও জানিয়ে রাখতে হবে, এই দুটো উপন্যাস আমি লিখেছিলাম আগাথা ম্যাক্স ম্যালোয়ান নামে। তার একটি হলো কাম টেল মি হাউ লিভ অপরটি হলো স্টার ওভার বেথেলহেম। সামাজিক উপন্যাস লেখার যে ইচ্ছে আমার মনের মধ্যে ছিলো অনেকদিন ধরে, সেই ইচ্ছেপাখীর সফলতা আকাশে ডানা মেলে দিয়েছে এই দুটি উপন্যাসের মাধ্যমে।
আমার দুর্ভাগ্য, আপনাদের কাছে আমি পরিচিত শুধুমাত্র একজন রহস্য লেখিকা হিসেবে। কোনদিনই আপনারা অন্বেষণ করেন নি যে, আগাথা ক্রিস্টি রহস্য সাহিত্যের জননী হিসেবে পৃথিবীর আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে বেঁচে থাকতে চায় না। সে চায় একজন সাহিত্যিক হিসাবে মানুষ তাকে মনে রাখুক। কিন্তু প্রথম কাহিনীর মধ্যে দিয়েই তার ললাটে রহস্য লেখিকার যে ছাপ পড়ে গেছে, জীবনের ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সে-ও বোধ হয় সেই ছাপ থেকে নিজেকে একেবারে বিমুক্ত করতে পারছে না। এটাই তার অহঙ্কার, অভিমান, কলঙ্ক বা অনুগত্য যা-ই হোক না কেন এর কোন উত্তর কি আপনাদের জানা আছে?
মেরী ওয়েস্ট মারকট নামে আমি ছ-ছটি উপন্যাস লিখেছি। সেগুলো হলো অ্যাবসেন্ট ইন দ্যা স্প্রিং, দি বার্ডেন এ ডটার, জায়েন্টস ব্রেড, দি রোজ অ্যাণ্ড দ্য টিউট্রি এবং আনফিনিসড পোট্রেট।
এই সাতটি উপন্যাসই মোটামুটিভাবে জনপ্রিয় হয়েছিলো। আমার ছদ্মনাম দেখে অনেকেই ভাবতে পারেনি যে মেরী ওয়েস্ট মারকট আসলে আগাথা ক্রিস্টিরই ছদ্মনাম। তাই একজন নবাগতা লেখিকার লেখা রচনা তারা সাদরে গ্রহণ করেননি। কিন্তু যখনই আমার প্রকাশিত পুস্তক তালিকার মধ্যে এই নামটি প্রকাশিত হয়। তখন হঠাৎ বেড়ে যায় তাদের প্রকাশ তালিকা। তারা সবাই ছুটে আসে যে রহস্য সম্রাজ্ঞী আগাথা ক্রিস্টি কেমন রোমান্টিক উপন্যাস লিখতে পারে সেটা জানতে। আর তখনই ভীষণ-দুঃখ হয়েছিলো আমার। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সাহিত্যের অঙ্গনে একজন নবাগতার কোন স্থান নেই, যতক্ষণ না সে সাফল্যের স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে উপনীত হতে পারছে ততক্ষণ তাকে এই অপমানের জ্বালা বহন করতে হবে।
এবার বোধহয় শেষ হয়ে আসছে আমার আত্মজীবনীর পালা। অনেক কথা বলবো বলে কলম ধরেছিলাম, কখন যে দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত হয়ে গেল সারা বেলা, সূর্য এখন বসেছে পাটে। এবার যদি কলম না থামাই তাহলে অনেক বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে নাকি।
পাঠক-পাঠিকারা, যাবার আগে আবার আপনাদের মনের দরজায় করাঘাত করে যাই। যদি মনে হয় আগাথা ক্রিস্টির রচনা আপনাদের মনকে অনাস্বাদিত আনন্দে পরিপূর্ণ করতে পারেনি, তাহলে দোহাই আপনাদের আর পড়বেন না, এরকুল পোয়ারোর কীর্তিকাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকবেন না, পার্কার পাইনকে দেখে বিস্মিত হবেন না। মিস মারপলের ছলকলায় আপনারা ভুলে যান আগাথাকে, ভুলে যান তার লেখনীসম্ভার। টুপি খুলে কুর্নিশ জানান নতুন যুগের নতুন সাহিত্যস্রষ্টাকে। যার অদম্য কৌতূহল, অগম্য আশা আর সৃষ্টিজাল বুনে সে আপনাদের মনকে পরিপ্লাবিত করুক অনাস্বাদিত আনন্দে।
বিস্মৃতির কোন ক্ষণে, কোন বৈকালিক সান্ধ্য আসরে হাঠৎ মনে পড়ে যায় এরকুল পোয়ারো নামের সেই বেলজিয়ান গোয়েন্দাকে। তাহলে ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে স্মৃতি ভারে টলমল তরণী ভাসান জীবনের উদ্যানে আর ভাবুন তার স্রষ্টা আগাথা ক্রিস্টির কথা! জীবনের প্রথম প্রহর থেকে যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো সৎসাহিত্যের মাধ্যমে আপনাদের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাবার।
অতিরিক্ত সংযোজনা–আই, ডেম আগাথা-রহস্য সাহিত্য সম্রাজ্ঞী আগাথা ক্রিস্টির এক অসাধারণ রচনা। এই রচনার মধ্যে আগাথা ক্রিস্টি অকপট স্বীকার করেছেন তার ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের নানা কাহিনী। কেমন করে তিনি লেখিকা হবার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং ধীরে ধীরে প্রবল আত্মবিশ্বাসকে পাথেয় করে অবশেষে সফল করে তুলেছিলেন তার এই স্বপ্ন। সেই কথা আমাদের সকলকে বিস্ময়ে অভিভূত করে। শুধুমাত্র পাঠক পাঠিকারাই নয়, আগামী দিনে যারা সাহিত্যরচনা করবে যাদের হৃদয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে একজন মহান সাহিত্যিকের সমস্ত গুণাবলী। তাদের অবশ্য পড়া উচিত আগাথা ক্রিস্টির এই আত্মকাহিনী। এই আত্মকাহিনী একটি হারিয়ে যাওয়া আর্থ-সামাজিক অবস্থায় মূল্যায়ন! এখানে ইংলণ্ডের ক্ষয়িষ্ণু সমাজের শেষ প্রতিভূ হিসেবে আমরা আগাথাকে ধরে নিতে পারি। যিনি চেষ্টা করেছিলেন নীলরক্তের অহমিকার মধ্যেও সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে বৃদ্ধিত আশা আকাঙ্ক্ষার ছবি আঁকতে। অভিজ্ঞতার রঙীন ক্যানভাসে সেই ছবি হয়তো মাঝে মধ্যে হয়ে গেছে রক্ত রঞ্চিত। কখনো বা সেখানে এসে ভয় দেখিয়েছে প্রতি মুহূর্তে প্রেম, ঘৃণা, ভালোবাসা কিন্তু অচিরেই মানুষ যে মানুষ, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে মনুষ্যত্বের বীজ, এই কাহিনী বোধহয় সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করেছে। তাই আমাদের উচিত আগাথা ক্রিস্টির রচনাবলী পাঠের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রহস্য সম্রাজ্ঞীর উদ্দেশ্যে আমাদের শ্রদ্ধা বিনম্র প্রণাম জানানো, জীবনে জটিল কঠিন চলার পথে একা একা তিনি অতিক্রম করেছেন শত সহস্র বাধা, নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন। এতগুলি রহস্য উপন্যাস, তার দুঃখ ছিলো যে, সামাজিক উপন্যাসের কেন তার উত্তোরণ ঘটবে, সেই সব সামাজিক উপন্যাসও আমাদের অনুধ্যান সহকারে পাঠ করতে হবে। যাতে আমরা লেখিকা আগাথার দুটি সত্ত্বাকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারি। একদিকে তিনি ছিলেন রহস্য লেখিকা অন্যদিকে তিনি ছিলেন সামাজিক ঔপন্যাসিক। এই দুই বিরোধী সত্ত্বার পারস্পরকি সংঘর্ষে মানুষ এবং লেখিকা হিসাবে যে আগাথা ক্রিস্টি আমদের চোখের সামনে মূর্ত ও প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। তার উদ্দেশ্যে নত মস্তকে প্রণাম জানানো ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারি আমারা।