যৌবন অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কখন যে বার্ধক্য এসে আঁকড়ে ধরেছিল, কে তার খবর রাখে। ১৯৭১ সাল শুধুমাত্র লেখার জন্য আমাকে দেওয়া হলো বহু ঈপ্সিত ডেনের সম্মান। হলাম আমি বৃটিশ রাজতন্ত্রের প্রতিভূ শিরোপা মাথায় দেওয়া এক সম্মানীয়া নারী, তখন থেকেই নানা সেমিনারে, অধিবেশনে নিয়মিত ডাক পড়তো আমার। আর কি আশ্চর্য, যে ভাষণ দেওয়াতে আমি অত্যন্ত লজ্জাবোধ করতাম, মাঝে মাধ্যে সেই ভাষণ দিতে হতো আমায়। বহু উপেক্ষিত উপস্থিত শ্রোতারা বার বার ছুঁড়ে দিতে অজস্র প্রশ্ন। এরকুল পোয়ারো নামে সত্যি সত্যি কোন গোয়েন্দা আছে না কি পৃথিবীর বুকে? যদি বা থাকে তাহলে তার আসল পরিচয় কি? কোথায় থাকে সে? কি খায়? কেমন করে এত সহজে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে একটির পর একটি রহস্য যবনিকার আবরণ উন্মোচিত করে। এমন কত শত প্রশ্ন।
বুঝতে পারতাম আমি আমার রহস্য কাহিনীর প্রতিটি অক্ষরকে সাধারণ পাঠক-পাঠিকারা সত্য বলে মনে করেছে। আর এই সত্যটাকে প্রকাশ করতে চাইছে এমন আকুলতা জমে আছে তাদের হৃদয়ের মধ্যে।
বড় মায়া হতো আমার, বড় সাধ হতো আমার, ভাবতাম, ঈশ্বর যদি আমাকে সে শক্তি দিতো তাহলে আমি হয়তো উপন্যাস লিখে জয় করতে চেষ্টা করতাম তাদের হৃদয়, পর মুহূর্তেই অন্যতর এক উন্মাদনা এসে ক্লান্ত করতে আমার হৃদয়কে। আমি ক্রাইম উপন্যাসের মধ্যে যে থ্রিল সাধারণ পাঠিকারা অনুভব করে। বৃহত্তম সামাজিক উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে তা অনেকখানি অপ্রাপ্তব্য থেকে যায় তাদের কাছে। এমন উপন্যাসের অনেক চরিত্রের সঙ্গে সে নিজের মিল খুঁজে পায়। এমন অনেক চরিত্রের দর্পণে সে খুঁজে পায় তার হারানো দিনের প্রতিচ্ছবি যে, সেই কাহিনীর সঙ্গে একীভূত হতে তার কোন বাদ সাধে না।
উপন্যাসের ক্ষেত্রে এমনটি সবসময় না-ও ঘটতে পারে।
আমি তো আর চার্লস বা বার্নাড শ হবার স্বপ্ন দেখি না। ঈশ্বর বোধহয় আমার নির্দিষ্ট গণ্ডীপথ স্থির করে দিয়েছেন। আর তার মধ্যেই নিরন্তর পথ চলে জীবনের অন্তিম সময়ে পৌঁছতে হবে আমাকে।
এসব কথা চিন্তা করার সঙ্গে সঙ্গে শান্ত সমাহিত হতো মন। আমি আবার ডুবে যেতাম আমার লেখনীর জগতে। সাধারণতঃ সকাল থেকে বেলা দশটা অব্দি লিখতাম আমি। তারপর সামান্য কিছু খাওয়াদাওয়া সেরে লনে পায়চারি করতাম। দুপুর বেলা শুরু হতো আমার দ্বিতীয় পর্বের লেখা। যখন সূর্য যেতো অস্তাচলে তার মায়াবী আলোয় পৃথিবী হয়ে উঠতে আরো বেশী রমণীয় এবং মনোমুগ্ধকর, তখন হঠাৎ লেখা থামিয়ে ডেস্ক থেকে এসে দাঁড়াতাম ছোট্ট পোর্টিতে। আর দেখতাম কেমনভাবে আসন্ন সন্ধ্যার ঘন অন্ধকার এসে অপসৃয়মান পৃথিবীর ওপর এঁকে দেয় চুম্বিত চুম্বনখানি। আর সন্ধ্যায় আকাশে মেঘ বালিশে মাথা রেখে তারা শোনে অশ্রুত অব্যক্ত কাহিনী।
এই সব কাহিনীর মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে জীবনরহস্য। ঐ আকাশে নিভু নিভু তারায়, বাতাসের শিরশিরানিতে, থমকে যাওয়া কাঠবেড়ালির চলায়, দূর থেকে ভেসে আসা কোন জাহাজের সঙ্কেত ধ্বনিতে, রেলওয়ে সিগন্যালের অপসৃয়মান শব্দ কোথায় না রহস্য নেই, কেউ কি বলতে পারে?
বিধাতা বোধহয় পৃথিবীর প্রতিটি পল অনুপলকে এমনভাবে রহস্যের আবরণে আচ্ছাদিত করেছেন। তাই তো জীবন তার সমস্ত একঘেঁয়েমি এবং গতানুগতিকতা সত্ত্বেও এত আকর্ষণীয়ভাবে ধরা দেয় আমাদের চোখের সামনে।
প্রকৃতি আর মানুষ–এই দুই নিয়েই তো সাহিত্যিকের জীবন। কখনো প্রকৃতির বৃহৎ প্রেক্ষপটে নীরব নিরুচ্চার মানুষের প্রেম, দুঃখ, ভালোবাসা, আবার কখনো মানুষের মহত্তর চরিত্র সৃষ্টির কাছে প্রকৃতির ক্ষুদ্র এই অহর্নিশ হাত আর জিতের লড়াই নিয়েই যে সাহিত্যিকের সাহিত্য ভাণ্ডার পরিপুষ্ট হয়।
সর্বমোট ৭৯ খানি গল্প সংকলন এবং উপন্যাস লিখতে হয়েছে আমাকে। তার মাধ্যমে বিশ্লেষিত করার চেষ্টা করেছি আমার ফেলে আসা জীবনের অনেক বাহিনী। এ পর্যন্ত ৪৪ টি বিদেশী ভাষায় অনুদিত হয়েছে আমার লেখা। এবং সব মিলিয়ে বোধহয় ১ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে শুধুমাত্র ইংরেজী ভাষাতে। বিদেশী ভাষাতেও তা বিক্রির সংখ্যা ১ কোটি কাটিয়ে যাবে। অনেকে বলে থাকে যে বাইবেল এবং শেক্সপীয়ার ছাড়া আর কোন সাহিত্য এত বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি।
কথা শুনে নতমস্তক হয় আমার। অহঙ্কার এসে কি গ্রাস করতে চায় আমাকে। সত্যিই তো কখন যে ৭৯ টি রহস্যধর্মী উপন্যাস আর ছোট গল্প লিখেছি, ১৯টি নাটক আর মেরী ওয়েস্ট নামের আড়ালে ছটি রোমান্টিক রচনা লিখতে হয়েছে আমাকে। সেসব খবর বোধহয় আর মনে পড়ে না।
আগাথা ক্রিস্টি এখন কি সহস্র সম্রাজ্ঞী হবার স্বপ্ন দেখতে পারে তার বিস্মিত চোখের তারায়?
আমার শেষ কাহিনী প্রকাশিত হলো ১৯৭৫ সালে। একটির নাম হলো কার্টেন, পোয়ারোর লাস্ট কেস। অপরটিকে বলা হয় স্লিপিং মার্ডার। এখানে মিস মারপলের কথা আছে। এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭৬ সালে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই বইটিকে বেস্ট সেলারের আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো। একদিন যাত্রা শুরু করেছিলাম দি মিস্ট্রিরিয়াস অ্যাফেয়ার্স দিয়ে। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে নিরন্তর লেখনীর মাধ্যমে এবার বোধ হয় শেষ হতে চলেছে আমার কাহিনী, তাই কার্টেনের পর্দা টেনে দিয়ে আমি শেষ করতে চাই আমার জীবন নাটকের যবনিকা। কিন্তু জানি পাঠক-পাঠিকাদের মোটেই মনঃপুত হবে না। এই অংশটি। কেননা জানার কি শেষ আছে? রহস্য কি কোনদিন ফুরিয়ে যায়? চিরদিন তার মাথাখানি শুধু দেখা যায়, বাকী অংশটুকু লুকিয়ে আছে গভীর সমুদ্রে অতল তলে।