এমনভাবেই অতিক্রম হতে থাকে বছরগুলি। একের পর এক উপন্যাস এসে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। মনে হয়, এটাই বোধহয় আমার জীবনের একমাত্র ডেসটিনি বা ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ রেখা। যতদিন বাঁচবো, যতদিন শ্বাসগ্রহণ করতে হবে আমাকে, যতদিন সচল থাকবে আমার মস্তিষ্ক এবং চেতনাপুঞ্জ, ততদিন নিরন্তর লেখনীর মধ্যে আত্মনিয়োগ করতে হবে আমায়, এছাড়া কোন মুক্তি নেই।
দেখতে দেখতে অনেকগুলি উপন্যাস লেখা হলো আমার। বিশেষ করে মনে পড়ে এ বি সি মার্ডার, দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ক্রীসমাস পুডিং, আফটার দ্য ফিউনারেল, অ্যাণ্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নাম ইত্যাদি।
যে উপন্যাসগুলির কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না তার মধ্য একটি হলো ওয়ান টু বাকল মাই সু। এখানে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা রহস্য যবনিকা আমি উন্মোচিত করেছি পাঠক-পাঠিকার সামনে। আপাততুচ্ছ ক্ষুদ্র বিষয় যে কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে, কত রোমাঞ্চিত তার আবরণ-তা বোধহয় এই উপন্যাসটি পড়লে বোঝা যেতে পারে।
ইভিল আণ্ডার দ্য সান হলো আমার আর একটি প্রিয় উপন্যাস। এই উপন্যাসটির পটভূমিতে আমি দেখিয়েছি প্রিয়জন হঠাৎ হণ্ডারকের বেশে এসে মাথার শিয়রে দাঁড়ায় এবং এক নিমেষে জীবন কেড়ে নিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করে না। স্পার্কলিং সায়ানাইড হলো আমার একটি বুদ্ধিদীপ্ত উপন্যাস। সম্পূর্ণ প্রতীকধর্মী রূপক শব্দের ব্যবহারে আমি সাজিয়েছি আমার রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীকে।
দি হলো একটি সাঙ্কেতিক উপন্যাস। ছোট্ট ছকের মধ্যে মানুষের নিয়তির কান্না জমে আছে এই উন্যাসের ক্যানভাসে, যা মানুষকে মনে করায়-এ জীবন কত নশ্বর, কোন কিছুই এখানে চিরস্থায়ী হতে পারে না।
থ্রি অ্যাক্ট ট্রাজেডি একটি বেদনাবিধুর গাথা। এখানে ধ্বনিত হয়েছে এক অসহায় মানুষের প্রবল আকুতি। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাকে সাজতে হয়েছিলো। খুনীর রক্তাক্ত সজ্জায়, অন্তিমে যার জীবন নির্ধারিত হয়ে যায় জেলাখানার অন্ধকারে। তারও অন্তরে প্রোথিত ছিলো ব্যথা আর অভিমান, এইসব কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে ট্রাজেডির পাতায় পাতায়।
দি মার্ডার অ্যাট দ্য ভিকারেজ, মার্ডার ইজ ইজি, মার্ডার অন্য দ্য লিংকস-খুন আর খুনের মিছিল শোনাচ্ছে না কি? তাহলে শুনবেন, এখনও শেষ হয়নি এই মার্ডার ইতিবৃত্ত। মার্ডার অন্য দি ওরয়েন্ট এক্সপ্রেস, এ মার্ডার ইজ অ্যানাউনসড, মার্ডার ইন দ্য নিউজ, মার্ডার ইন সোপটেমিয়া ইত্যাদি আরো কত কি, আসলে মার্ডার মার্ডার করেই তো আমার সাহিত্যের সবখানে বেজে ওঠে স্পন্দন। সে মৃত্যু কখনো আসে মধ্যরাতে বোরখা পড়ে, আবার কখনো তার হাতে ঝলসে ওঠে তীক্ষ্ণ ছুরিকা। হাসতে হাসতে সে অনায়াসে ছুরি চালিয়ে দেয় তার প্রিয়জনের বুকের মধ্যে।
মৃত্যু যে কত বিচিত্র রূপে মানুষকে ভয় দেখায়। শয়তানের বেশে, কখনো গৈরিক ভঙ্গিমায়, কখনো বা তুষারাবৃত পর্বতের নিরাপত্তায়। আমরা তার সব খবর হয়তো জানি না।
এরকুল পোয়ারোর মত ধুরন্ধর গোয়েন্দা আছে বলেই উন্মোচিত হয় প্রতিটি রহস্যের যবনিকা জাল। যা ছিল ঘন কুঙ্কুটিকায় আচ্ছন্ন তার অন্তরালে সূর্য ঝিলিক মেরে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি জীবনের চলার পথ যতই কণ্টকাকীর্ণ হোক না কেন তার কোথাও না কোথাও জেগে উঠবে কুসুম রেখা।
পোয়ারোর কথা বলতে গেলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে কি?
লোকটা অত্যন্ত সাধারণ। মাথা জোড়া টাক, নাদুসনুদুস চেহারা। কিন্তু কত সহজে তিনি যে পৌঁছে যেতে পারে রহস্যের গভীরে, আর একেবারে শেষ বিন্দুটিকে আহরণ না করা পর্যন্ত এক মুহূর্তের ছুটি মেলে না তাঁর। বোধহয় লেখা আছে আমার বিভিন্ন উপন্যাসের পাতায় পাতায়।
আর কিছু গল্প করা যাক। শুনুন সিক্রেট অ্যাডভারসরীর কথা দি, আখ্যায়িকা, দি স্লিপিং মার্ডারের ইতিহাসে, দী স্পার্কলিং সায়ানাইডের বিচ্ছুরণ।
প্রতিটি গল্পেই বোধহয় বিষয়-বৈচিত্র্যে একে অন্যের চেয়ে অন্য দিগন্তের বাসিন্দা। একটি গল্প পড়লে তার সঙ্গে অন্য গল্পটির কোন মিল পাওয়া যাবে না। চেষ্টা করেছি আমি সম্পূর্ণ নতুনতর আঙ্গিকে একটির পর একটি কাহিনীকে আপনাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে। যাতে মনে হবে যে, কোন কাহিনী বুঝি আগে আপনারা পড়েননি।
পোয়ারো ছাড়াও, আগেই বলেছি, আমার অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র হলো পার্কার পাইন। যদিও অনেক বেশী কাহিনীর মধ্যে সে এসে দাঁড়ায়নি আপনাদের বিস্মিত চোখের পাতায়। কিন্তু সীমায়িত পরিসরে পার্কার পাইন যে সমস্ত অসাধ্য সাধন করেছে তারই বা কম মূল্য আছে নাকি?
মিস মারপল, তার কথাও জানিয়েছি আগে। বোধহয় বিশ্বের এক অনন্য সাধারণ মহিলা গোয়েন্দা, দেখতে অতি সাধারণ হলে কি হবে অনেকের মত সে কিন্তু তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখের তারায় সব সময় ঘুরঘুর করছে কোন এক রহস্য রোমাঞ্চ আস্বাদনে।
আসলে মিস মারপলের মধ্যে আমার অত্যন্ত পরিচিত পরিজনের ছায়া আছে। মিস মারপল আসলে আমার ছোটবেলার স্কুলে হারিয়ে যাওয়া এক আন্ট। ক্লাসে দেখতাম সেই আন্ট সবসময় প্রশ্নের পর প্রশ্নবানে বিদ্ধ করছে আমাদের মত বালিকাদের হৃদয়। আর পরিশেষে জানতে চাইছে এমন অনেক কথা-যার উত্তর আমাদের জানা নেই।
টিফিনের সময়, অবসরে, প্লে গেমসের আসরে, আমরা মাঝে মধ্যেই ধরা পড়ে যেতাম সেই মিস মারপলের কাছে আর ভয়ে ভয়ে সব কিছু কবুল করতে হতো। তখন থেকেই বোধহয় কল্পনার রঙে রসে মিলেমিশে একটি নারী গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টির ইতিহাস জেগে ছিলো মনের মধ্যে। পরবর্তীকালে যার প্রকাশ ঘটে আমার লেখনীর পাতায় পাতায়।