এই সামাজিক অবক্ষয়ের ছবিটা আমার কাছে আরো ভালোভাবে ধরা পড়েছিলো। কেননা আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলাম। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মহিলাকর্মী হিসাবে। সেই অবস্থাতে আমি লক্ষ্য করেছি–কিভাবে মানুষ শুধুমাত্র উন্মাদ উত্তেজনায় হত্যা করে প্রিয়জনকে। দুহাতে পরম প্রিয়জনের রক্ত মেখেও উল্লাসের হাসি হেসে ওঠে তার ঠেটের কোণে। এইসব দৃশ্য চোখের সামনে ঘটতে দেখে আমার কেবলই মনে হয়েছে, মানুষ আসলে চারপেয়ে এক জন্তু। তার মধ্যে আমরা যতোই ঈশ্বরত্ব আর মনুষ্যত্বের বীজ প্রোথিত করার চেষ্ট করি না কেন, কোন পরিবর্তনই হবে না তার চরিত্রে। আমার লেখার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এইসব টুকরো টুকরো স্মৃতির ছবি বার বার ছায়াপাত করেছে। তাই হয়তো এতখানি জীবন হয়ে উঠতে পেরেছে আমার লেখনী সম্ভার।
বিশ্বযুদ্ধের সময় আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো প্রকৃতির আদলে গড়া একটি মানুষের। যাকে আমরা বেলিজয়াম গোয়েন্দার ভূমিকায় সাজিয়েছি এবং পরবর্তী কালে সেই একদিন শার্লক হোমসের মত কিংবদন্তী নায়কের সমকক্ষ হয়ে উঠবে তা হয়তো জানা যায় নি।
আমার প্রথম সেই উপন্যাসে, দি মিষ্ট্রিরিয়াস অ্যাফেয়ার্স অ্যাট স্টাইলস, যেটি প্রকাশিত হয়েছিলো কর্নেএড পাবলিশিং কোম্পানি থেকে। আসলে সেটি আমাকে আমার ঈঙ্গিত লক্ষ্যের দিকে পৌঁছে দেয়। প্রথম উপন্যাসের মধ্যে আমি বিরাট প্রেক্ষাপটের একাধিক মানুষের হৃদয়ের গহন গভীর অরণ্যে লুকিয়ে থাকা লোভ, প্রেম-ভালোবাসা, কামনা-বাসনার ছায়া ছবিগুলিকে খণ্ড খণ্ড বিমূর্ত প্রতাঁকের মাধ্যমে চিরায়ত করে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম, হয়তো-বা জীবনের প্রথম লেখা বলে এর মধ্যে ছিলো আতিশয্য। হয়তো আমি ভেসে গিয়েছিলাম অকারণ সংলাপের প্রাচুর্যে, হয়তো ঠাসবুনুনি গল্পের প্রকার বা প্রকাশ ঘটেনি তার মধ্যে, কিন্তু পরম মমতায় আমি এখনও পর্যন্ত আমার প্রথম উপন্যাসটিকে বাকি সব লেখার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হিসেবে গণ্য করি। এই উপন্যাসটি সৃষ্টি করতে না পারলে আমি তো কোনদিন আগাথা ক্রিস্টি নামে পরিচিত হতে পারতাম না আপনাদের মনের দুয়ারে। আমি পৌঁছে যেতাম অপরিচিতার অন্ধকারে।
দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত হলো আরো ছ-ছটি বছর। তখন প্রত্যেক বছর একটি করে উপন্যাস লিখে চলেছি আমি আর বিভিন্ন লেখার মধ্যে বিষয় বৈচিত্র্যে নিত্য-নতুন নৈপুণ্য আনবার প্রয়াসে মগ্ন রয়েছি। দেখা আর শোনার জগতের পরিধি অনেক বেড়ে গেছে। কত মানুষ এসে ধরা দেয় অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়, কেটে যায় ক্লান্ত মৌন প্রহর। কিন্তু মনের মধ্যে সব সময় জ্বলে অতৃপ্তির আগুনশিখা। মনে হয়, এমন এক লেখা সৃষ্টি করতে হবে, যা মৃত্যুর পরেও আমাকে দেবে অমরত্ন। যার মাধ্যমে আমি পৌঁছে যেতে পারবো যে কোন লেখকের সেই বহু ঈপ্সিত আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পথে।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত হলো আমার রহস্য উপন্যাসটি দি মার্ডার অব রজার অ্যাট রাইট এবং পরবর্তীকালে সমার্লোচকদের মতে এটি নাকি আমার অন্যতম মাস্টারপিস যার মধ্যে শুধুমাত্র রহস্য গল্পের ছোঁয়া নেই, আছে এক সাহিত্যের ছায়া। প্রতিটি মানুষ মনে মনে যে যতই অসৎ হোক না কেন সত্য এবং শিবের পূজারী। সত্যম শিবম সুন্দরম্-এর আদর্শপ্লুত মানুষের এই জয়গানকেই আমি প্রতিধ্বনিত করতে চেয়েছি দি মার্ডার অব রজার অ্যাট রাইট এর পাতায় পাতায়। আমার চোখে কোন খুনী বদমাস ধৰ্ষকও প্রকৃতপক্ষে একজন সাধারণ ভীরু অসহায় মানুষ। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করতে করতে দুহাতে মাখতে হয়েছে পরম প্রিয়জনের রক্ত। চোখ ঢাকতে হয়েছে লোভ আর লালসার মুখোসে। আমাদের সামনে এক লোভী হণ্ডারকের বেশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যদি কোন সময় উন্মোচিত হয়ে যায় তার মুখোসখানি। আবার চোখে পড়ে তার স্নিগ্ধ সৌকুমার্য ভরা মুখ। তাহলে দেখবো সেখানে কত রাতের ক্লান্তি টলটল করছে তার চোখের তারায়। মনে আছে কোন না বলা কথা। তার বুকের গভীর দহনে খাঁচার থেকে উৎসারিত দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মত প্রতি মুহূর্তে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে কত বেদনা।
আর তখনই পরমশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতি অত্যন্ত শত্রুভাবান্ন হয়ে উঠি আমি। মনে মনে ছুঁড়ে দিই অসংখ্য প্রশ্ন–হে ঈশ্বর, তুমি কেন মানুষকে অসহায়তার মধ্যে পাঠালে পৃথিবীর বুকে? কেন তাকে সাজালে না মন্ত্রে, যে মন্ত্র তাকে উদ্বুদ্ধ করবে জীবনের চলার পথে পা ফেলতে।
এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিলো কলিন্স থেকে। এর মধ্যে দিয়েই আমাদের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ৫০ বছরের আগের পুস্তক প্রকাশন থেকেই আমার ৫০ টি বই প্রকাশিত হয়েছিলো। যা সারা পৃথিবার পাঠক সমাজে একেবারে স্তম্ভিত করে দেয়। মি মার্ডার অব রজার অ্যাট রাইট-কে আর একটা কারণে মনে রাখতে হবে। কারণ এই বইটি প্রথম নাট্যাকারে মঞ্চস্থ হয়েছিলো লণ্ডনের বিশিষ্ট প্রেক্ষাগৃহে। এবং রাতের পর রাত অভিনীত হওয়ার সূত্রে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেটিকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। নাটকে এর নাম দেওয়া হয়েছিলো অ্যালিবাই। ওয়েস্ট এণ্ডের মতো থিয়োরেটিক্যাল হলে কত রজনী উপস্থাপিত হয়েছিল তার কোন সংখ্যা হয়তো আমার জানা নেই। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করতে পারি যে মাউসট্রাপ নামে যে উপন্যাসটি আমি লিখেছিলাম সেটি হলো আমার সবচেয়ে বিখ্যাত। তা একটানা উনিশ বছর ধরে অভিনীত হয়ে বিশ্বের রঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছিলো।