প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। প্রশংসার চিঠি পেতে থাকি আমি। মন ভরে ওঠে এক আশ্চর্য প্রশান্তিতে। তাহলে আমিও পারি আমার মনের ভাব আর ভাবনাকে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করে তা পৌঁছে দিতে সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের মনের কাছে।
শুরু হয় নিরন্তর সাধনা। যা ছিলো নেহাতই খামখেয়ালী মনোভাবের প্রকাশ, এখন তার মধ্যে এসেছে পেশাদারিত্ব মনোভঙ্গী। আমি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়েজিত করলাম আমার লেখার জগতে। ধীরে ধীরে জমে উঠতে থাকে আমার লেখনী, একের পর এক নতুন নতুন লেখার মাধ্যমে আমি অচিরেই লাভ করি পাঠকসমাজের কাছে স্বীকৃতি। সত্যি কথা বলতে কি, সাহিত্য জীবনে চলার শুরু থেকেই এমন অজস্র অভিনন্দন আর প্রশংসা না পেলে হয়তো আমার পক্ষে এতখানি পথ অতিক্রম করে আজ এখানে এসে উপনীত হওয়া সম্ভব হতো না।
বিভিন্ন পত্রিকাতে নিয়মিত লেখার আমন্ত্রণ আসতে থাকে। এ ব্যাপারে আমি ছিলাম অত্যন্ত সাবধানী। সব পত্রিকাতে লিখতাম না। তখনকার বিখ্যাত কয়েকটি মাত্র পত্রিকার পাতাতেই ধারাবাহিক উপন্যাস এবং গল্প লিখতাম আমি ।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন যে–কেন আমার প্রধান চরিত্র এরকুল পোয়ারোকে এরকম সাজিয়েছি? যখন অন্যান্য বিখ্যাত গোয়েন্দারা ঝকঝকে স্মার্ট, সুতনু সুদেহী যুবক, তখন আমার গোয়েন্দা কেন এক প্রৌঢ়, মাথায় টাক? এর অনেক উত্তর আছে। তবে তার প্রথম কথা হলো, আমি দেখাতে চেয়েছি যে, গোয়েন্দা আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। তাদের চেহারার মধ্যে এমন কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে না যা তাকে অন্য সকলের থেকে আলাদা করে দেয়। শুধু আছে তার একটি ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, আর তার সাহায্যে সে একের পর এক রহস্য ভেদ করে। ঠিক যেমন আমার গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো বিন্দুমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করে, হিংসা বা মারামারির আশ্রয় না নিয়ে, একের পর এক রহস্যজাল ভেদ করেছে। তেমনই কত গোয়েন্দা লুকিয়ে আছে আমাদের চারপাশে, কেউ তার খবর রাখে না।
লিখতে লিখতে মনে হয়েছে আমার, শুধুমাত্র একটি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করলেই বোধহয় সমস্ত কথা আমি ঠিকভাবে প্রকাশিত করতে পারবো না। তাই জন্ম হয়েছে মিস মারপলের। ইংরেজী সাহিত্যে এর আগে এমনভাবে কোন মহিলা গোয়েন্দার আবির্ভাব হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সেদিন থেকে আমার মিস মারপল সত্যি সত্যি এক অনন্য সাধারণত্বের দাবী করতে পারে। তাকেও আমি দেখিয়েছি এক আশ্চর্য চরিত্রে নারী হিসেবে। তার চোখ দুটি ঘুরছে কোন নতুনতর সহস্য অন্বেষণে। একের পর এক ক্লান্তিহীন অভিযানে সে ভেদ করছে রহস্য যবনিকা আর নতুনতর সূর্যোলোকে উদ্ভাসিত হচ্ছে তার মুখ।
পার্কার পাইন হলো আমার তৃতীয় গোয়েন্দা। তাকেও কি অন্য সকলের থেকে একটু আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে? পার্কার পাইন জীবনের বিচিত্রতর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ মানুষ। অনেকবার তাকে দেখা গেছে উপত্যকায় নির্লিপ্তভাবে পায়ে হেঁটে যেতে। আবার কখনো কখনো বা সে ভাবিত ও তাড়িত হয়েছে অতি সামান্য সমস্যা সমাধান করতে, পার্কার পাইনের মধ্যে লুকিয়ে আছে আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার আশ্চর্য গল্প গাথা। সত্যি সত্যি তো মাঝে মধ্যে আমরা বিরাট সমস্যার সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াই। কোন সমস্যাকে সহসা অতিক্রম করতে ভয় লাগে আমাদের। আমার আর একটি যুগল গোয়েন্দা আছে। তার নাম হয়তো ইতিমধ্যে আপনারা জেনে ফেলেছেন, টু ফ্রেন্ডস অব টনি। এরা মাঝে মাঝেই এমন সব কাণ্ডকারখানা বাঁধিয়ে তোলে, যা হাসির সাথে সাথে প্রচণ্ড কৌতূহলের সৃষ্টি করে, অবশ্য বিরাট লেখনী সম্ভারের মধ্যে এই জোড়া গোয়েন্দাকে আমি খুব একটা বেশী ব্যবহার করিনি। কেননা সত্যি বলতে কি, এদের প্রতি কেমন একটা মায়া আছে আমার। তাই বার বার ব্যবহার করলে পাছে এদের প্রতি আপনাদের ভালোবাসা কমে যায়, তাই তাদের ইমেজকে রক্ষা করে চলতে হয়েছিলো আমাকে। এবার আমার লেখার প্রসঙ্গে কিছু বলি। আমার লেখার প্লট বা কাহিনীর গল্প গাথায় ছড়িয়ে আছে সেই যে কি যেন বলছিলাম, আমার ফেলে আসা জীবনের কথা। বৃটিশ রক্ষণশীলতা, অনাবিল প্রকৃতি বিচিত্র মানুষ–এসব নিয়েই তো কেটে গেছে আমার শৈশবকাল।
জন্মেছিলাম আমি টর্কিটে। আর যখন প্রথম উপনন্যাস লিখি তখন সবেমাত্র শেষে হয়েছে। অথবা শেষ হতে চলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই বিশ্বযুদ্ধ আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারাণার মূলে কুঠারাঘাত করেছিলো। এতদিন পর্যন্ত যে সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতকে আমরা জীবনের চরমতম অবলম্বন বলে ধরেছিলাম, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে যারা জন্মেছিলো হৃদয়ের সঙ্গে আত্মার আত্মীয় হয়ে হঠাৎ দেখা গেল সেইসব প্রথাগত ধারণার মূলে কারা যেন কুঠারাঘাত করেছে আর নূতন ঊনবিংশ শতাব্দী এসে সজোরে কড়া নাড়ছে মনের দরজায়।
বিশ্বযুদ্ধ যে শুধুমাত্র পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংজ্ঞাটিকেই পাল্টে দিয়োছিলো তা নয়। মানুষের মনের জগতে ঘটিয়ে দেয় এর বিরাট বিপ্লব। আর সেই বিপ্লবের সাথী ছিলাম আমি।
বিশ্বযুদ্ধ যখন বাধে তখন সমস্ত ইউরোপে জুড়ে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক বন্যা। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ঘন অন্ধকার। বিপদ এসে দেখাচ্ছে তার প্রচণ্ড মুখ ব্যাদান। মধ্যবত্তি সমাজ বুঝি আর কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না। এই সামাজিক অবক্ষরের সঙ্গে তাল দিতে দিতে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম। যেসব রমণী এতদিন ধরে সযত্নে রক্ষা করে চলছিলো তাদের আব্রু তাদেরকে দাঁড়াতে হয়েছে পথের পশারিণী হয়ে। যেসব মানুষ হৃদয়ের মধ্যে সতোর প্রদীপশিখা জ্বালিয়ে রেখেছিলো বাইরের ঝোড়ো হাওয়ার আক্রমণের মধ্যে থেকে, তারাও মুহূর্তে অসৎ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে যেন পৃথিবীর সবাই এক অদ্ভূত ইঁদুর দৌড়ে প্রতিযোগী হয়ে ছুটে চলেছে টাকা আর টাকার সন্ধানে।