এর পরে কয়েকটা দিন সে ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে উঠল। সেই রক্তাক্ত দাগটিকে যথাস্থানে। বসিয়ে দেওয়া ছাড়া নিজের ঘর থেকে সে বাইরে প্রায় বেরোল না বললেই হয়। যাই হোক, খুব সাবধানে থাকার ফলে সে সুস্থ হয়ে উঠল; সুস্থ হয়েই যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী আর তাঁর পরিবারবর্গকে শায়েস্তা করার জন্যে সে তৃতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে কৃতসংকল্প হল। তার পুনরাবির্ভাবের দিল ঠিক করল শুক্রবার, ১৭ই আগস্ট। সেদিনের বেশির ভাগ সময়টাই সে তার পোশাক রাখার আলমারিটা ঘাঁটল। অনেক ঘেটেঘুটে সে একটা লাল পালক দেওয়া খোলসের তৈরি টুপি বার করল; সেই সঙ্গে বার করল মরচে-পড়া একটা ছোরা। সন্ধের দিকে ভয়ঙ্কর ঝড়ের সঙ্গে শুরু হল বৃষ্টি। এত ডোরে বাতাস বইতে লাগল যে পুরনো বাড়ির জানালা-দরজাগুলো সব খটাখট করে শব্দ করতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি এই রকম একটা আবহাওয়াকেই সে পছন্দ করতে বেশি। তার পরিকল্পনাটা হচ্ছে এইরমক ওয়াশিংটন ওটিসের ঘরে সে নিঃশব্দে প্রবেশ করবে। বিছানার কাছে পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে সে বিড বিড় করে কথা বলবে; তারপর মৃদু একটা সঙ্গীতের সুরের তালে-তালে নিজের গলার মধ্যে তিনবার জােরটা বসিয়ে দেবে। ওয়াশিংটন ওটিস-ই ‘পিঙ্কারটনের প্যারাগন ডিটারজেন্ট দিয়ে বারবার সেই রক্তের দাগটা মুছে দিচ্ছে। এই জন্যে তারই ওপরে তার রাগটা ছিল বেশি। সেই বেপরোয়া আর মূর্খ যুবকটিকে ভয়ে একেবারে উথানশক্তিরহিত করে দিয়ে সে ঢুকে যাবে সেই ঘরে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী আর তাঁর স্ত্রী ঘুমোচ্ছেন। মিসেস ওটিসের কপালের ওপরে তার চিটচিটে হাতটা রেখে কবরখানার ভয়ঙ্কর গোপন রহস্যের কথা ফিসফিস করে মিঃ ওটিসের কানের কাছে আওড়াবো ভার্জিন্যি মেয়েটার ব্যাপারে সে এখনই কিছুই ঠিক করে উঠতে পারেনি। মেয়েটি বেশ শান্তশিষ্ট। এখনো পর্যন্ত সে তাকে কোনো আপমান। করেনি। ওয়ার্ডোবের ভেতর থেকে কয়েকটা শূন্যগর্ভ আওয়াজও তার পহেক্ক যথেষ্ট হবে। তাতেও যদি তার ঘুম না ভাঙে তাহলে সে কাঁচের জানালাটা বাগিয়ে ধরে একটু আঁচড়াবে। আর ওই যমজ ভাই দুটো, তাদের সে বেশ একটু শিক্ষা দেবেই। প্রথমেই অবশ্য সে তাদের বুকের ওপরে গিয়ে বসবে। তাদের মনে হবে দুঃস্বপ্ন দেখে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। তারপরে তাদের বিছানা কাছাকাছি বলেই, সে সবুজ বরফের মতো ঠাণ্ডা কনকনে মৃতদেহের মতো তাদের দুটি বিছানার মাঝখানে দাঁড়াবে; এতেই তারা ভয়ে জমে যাবে। শেষকালে, বিছানার চাদর দুটো তুলে সাদা ব্লিচ করা হাড় আর ঘূর্ণায়মান চোখ বার করে সে ঘরময় হামাগুড়ি দেবে।’ডাম্ব দ্যানিয়েল’ অথবা ‘সুইসাইড স্কেলিটনের’ অভিনেতার মতো দেখতে হবে তাকে। এই চরিত্রে অনেকবারই সে উন্নতধরনের পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। মার্টিন দ্য ম্যানিয়্যাক’ অথবা ‘দ্য মাস্কড মিস্ট্রি’-তে যে বিখ্যাত চরিত্রটি সে অভিনয় করেছিল এই অভিনয়টি মোটামুটি তারই কাছাকাছি যাবে।
সাড়ে দশটার সময় সবাই শুতে গেল। সে শব্দ সে শুনতে পেল। যমজ ভাই দুটোর উন্মত্ত চিৎকারে কিছুক্ষণ সে একটু অস্থিরতার মধ্যে রইল। তার মনে হল, স্কুলের ছাত্রদের মতো ছেলে দুটো ঘুমানোর আগে হালকা হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছে। কিন্তু সওযা এগারোটার সব শান্ত হয়ে এল। বারোটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বেরিয়ে পড়ল। কাঁচের জানালার পাশে পেঁচারা পাখার শব্দ করল; পুরানো ইউ গাছের ওপর থেকে চিৎকার করে উঠল দাঁড়কাকের দল;আর হারিয়ে যাওয়া আত্মার মতো আর্তনাদ করতে-করতে বাতাস ছোটাছুটি করতে লাগল। চারপাশে। কিন্তু নির্বিকারভাবে ওটিসের পরিবার ঘুমের বিভোর। তাদের কপালে যে কী লেখা রয়েছে সে কথা তারা ভাবতেও পারল না। ঝড-জলের শব্দ ছাপিয়ে মন্ত্রীমহোদয়ের নাসিকাগর্জন তার কানে এসে ঢুকল। তার সেই নিষ্ঠুর বলিরেখায় ভরা মুখের ওপরে কদর্য একটা হাসি ফুটিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল চুপি চুপি। মেঘের ভেতরে চাঁদ লুকিয়ে পড়ল যে বিরাট ‘ওরিযেল’ জানালার পাশে তার আর তার নিহত স্ত্রীর অস্ত্রগুলির নক্সা সোনার রঙে খোদাই করা ছিল সেখান দিয়ে সে পেরিয়ে এল। অমঙ্গল ছায়ার মতো সে এগোতে লাগল। মনে হল অন্ধকারও তাকে দেখে ঘৃণায় মুখ সঙ্কুচিত করছে। একবার মনে হল কার যেন ডাক শুনতে পাচ্ছে সে। মনে হতে সে থেমে গেল। না, ওটা হচ্ছে কুকুরের ডাক। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রচলিত অদ্ভুত অদ্ভুত অভিসম্পাতের শব্দ ফিসফিস করে আওড়াতে আওড়াতে সে এগোতে লাগল। মাঝে মাঝে মধ্যরাত্রির বাতাসের বুকে সেই মরচ-পড়া ছোরটা লাগল দোলাতে। অবশেষে যে বারান্দা দিয়ে হতভাগ্য ওয়াশিংটনের ঘরে ঢোকা যায় সেই বারান্দায় হাজির হল সে। মুহূর্তের জন্যে একটু দাঁড়াল। বাতাসে তার সাদা চুলগুলোকে ওলট-পালট করিয়ে দিয়ে সেই কদর্য মৃত লোকটার ভয়ঙ্করতা আরো বাড়িয়ে দিল। তারপরে সওযা বারোটার ঘণ্টা বাজল। সে বুঝতে পারল এবার সময় হয়েছে। মনের আনন্দে একটা চুকচুক শব্দ করে সে কোণের দিকে ঘুরে গেল। কিন্তু মুখটা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা করুণ ভয়ার্ত চিৎকার করে সে। থমকে দাঁড়াল, তারপরে সাদা ফ্যাকাশে মুখটা তার লম্বা হাড়ের দুটো হাত দিয়ে ঢেলে দিল। ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা ভয়ঙ্কর অশরীরী মূর্তি। চুপচাপ খোদাই করা মূর্তির মতো-উন্মাদের স্বপ্নের মতো ভোলা তার মাথাটা ন্যাড়া, বার্নিশ করা। তার মুখটা গোল, মোটা আর সাদা। মনে হল, একটা শাশ্বত ভ্রূকুটির ভেতর দিয়ে ভাল একটা অট্টহাসি। ফেটে-ফেটে পড়ছে। মুখটা যেন একটা আগুনে চুল্লি। অতিকায় দৈত্যের মতো চেহারার ওপরে তারই পরিধেঘের মতো বিশ্রী ভয়াল একটা পোশাক ঝুলছে। তার বুকের ওপরে একটা প্রাচীরপত্র সাঁটা। তার ওপরে প্রাচীন অহষ্করে কী যেন অদ্ভুত একটা লেখা। মনে হল ওর ওপরে লেখা রয়েছে কারও লজ্জার কাহিনি, কোনো উদ্দাম পাপের কাহিনি, কোনো পাপের ইতিহাস, তার ডান হাতে উঁচু করে ধরা রয়েছে চকচকে ইস্পাতের একটা কুকরি।