পরের দিন সকালে ওটিসরা ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে ভূতের বিষয়ে কিছু আলোচনা করলেন। তাঁর উপহার এটি গ্রহণ করেনি এটা দেখে যুক্তরাষ্ট্রের মিনিস্টার স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন-ভূতের শীরীরিক কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা আমার নেই, কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে ভূতটি এখানে বাস করছে সেই কথা ভেবে এটা বলতে আমি বাধ্য যে তাকে লক্ষ করে বালিশ ছোঁড়াটা ভদ্রতাসূচক হয়নি।
যথার্থ মন্তব্য; কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি যে এই কথা শুনে দুটি যমজ ভাই একেবারে হো-হো করে হেসে উঠল
মিঃ ওটিস বলে গেলেন–অন্য পক্ষে ‘রাইসিং সান লিউব্রিকেটর’ নিতে ওর যদি সত্যিই আপত্তি থাকে তাহলে ওর শেকলগুলি আমাদের খুলে নিতে হবে। কারণ ঘরের বাইরে এই ধরনের শব্দ হলে রাত্রিতে ঘুমের ব্যাঘাত হতে বাধ্য
সপ্তাহের বাকি কটা দিন অবশ্য তাঁরা নির্ঝঞ্ঝাটেই কাটিয়েছেন। ভূতটি কোনোরকম অদ্ভুত কাজ করার চেষ্টা করেনি। লাইব্রেরির মেঝেতে সেই রক্তের দাগটাই কেবল প্রতিদিন দেখা যাচ্ছিল–আর সেইটাই সকলকে বেশ উত্তেজিত করে রেখেছিল ব্যাপারটা সত্যিই বড়ো অদ্ভুত মিসেস ওটিস নিজে প্রতিদিন রাত্রিতে ওই ঘরটা চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিতেন; সেই সঙ্গে খুব শক্ত করে বন্ধ করা হত জানালাগুলি অবাক হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে এই যে রঙটা বহুরূপী। কোনো কোনো দিন সকালে ওটা ফিকে (প্রায় ভারতীয়) লাল, কোনো কোনো দিন সিঁদুরের মতো, কোনো কোনো দিন বা বেগনে। হঠাৎ একদিন প্রার্থনা থেকে ফিরে এসে তাঁরা দেখেন রঙটা হয়েছে উজ্জ্বল পান্নার মতো সবুজ রঙের এই দ্রুত পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা বেশ আমোদ পেতেন; আর এর আসল চরিত্রটা যে কী তাই নিয়ে বাজি ধরতে তারা দ্বিধা করতেন না। এঁদের মধ্যে একমাত্র ভার্জিনিয়াই ওঁদের। তর্ক-আলোচনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখত। এই রক্তের দাগ দেখে বেশ কষ্ট হত তার। যে সকালে রক্তটা পান্নার মতো সবুজ হয়ে দাঁড়াল সেদিনই আর একটু হলে সে প্রায় কেঁদেই ফেলত।
রবিবার রাত্রিতে ভূতটির দ্বিতীয় আবির্ভাব হল। সবাই শুয়ে পড়ার একটু পরেই হঠাৎ হলঘরের মধ্যে কিছু একটা ভেঙে পড়ে যাওয়ার শব্দ হল। সেই ভীষণ শব্দে সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। সবাই দৌড়ে নীচে নেমে এসে দেখলেন একটা জায়গায কতকগুলি পুরনো বর্ম ঝোলানো ছিল, সেগুলি স্থানচ্যুত হয়ে শানবাঁধানো মেঝের ওপরে পড়ে গিয়েছে। আর উঁচু পিঠওয়ালা চেয়ারে বসে রয়েছে ক্যানটারভিলে ভূতা বসে-বসে হাঁটু দুটো সে ঘষছে; আর ভীষণ যন্ত্রণায় বিকৃত করছে তার মুখ। যমজ ভাই দুটি তাদের খেলার বন্দুক সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। ভূতের মাথা লক্ষ করে অভ্রান্তভাবে তারা দুটো ছররা ছুড়ল; আর ক্যালিফোরনিয়ান ভদ্রতা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী রিভলভার উঁচিয়ে ভূতটিকে মাথার। ওপরে হাত দুটো তুলতে নির্দেশ দিলেন। রাগে বিকট একটা চিৎকার করে ভূতটি লাফিয়ে উঠল; তারপরে ধোঁয়ার মতো সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। যাওয়ার সময় ওয়াশিংটন। ওটিসের বাতিটা নিবিঘে দিয়ে চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে গেল। একেবারে থামল সিড়িঁর উপরে গিয়ে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে তার বিখ্যাত দৈত্যসুলভ হাসিটি হাসতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল। কয়েকবারই সে দেখেছে এই হাসিটি তার বড়োই কাজে লেগেছে। শোনা যায় এই দানবীয় হাসি শুনে একরাত্রিতেই লর্ড বেকারের অমন ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া কালো চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। আর মাস শেষ হওয়ার আগেই লেডি ক্যানটারভাইলের ফরাসি গভর্নেসরা চাকরি ছাড়ার নোটিশ দিতে বাধ্য হয়েছিল। সেই ভেবে সেই দানবীয় হাসিটি সে হাসল পুরনো বাডির খিলালে সেই ভয়ঙ্কর হাসিটি উন্মত্ত কলরবে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল; কিন্তু সেই প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতে না যেতেই সামনের একটা দরজা খুলে গেল; আর ফিকে নীল একটা ড্রেসিং গাউন পরে বেরিয়ে এলেন মিসেস ওটিস; বললেন–আমার ধারণা আপনার শরীরটা ভালো নেই। সেই জন্যে আমি এক বোতল ডাক্তার দোবেল-এর তৈরি মিকচার নিয়ে এসেছি। যদি বদহজম হয়ে থাকে তাহলে এতে আপনার যথেষ্ট উপকার হবে।
এই শুনে রাগে গরগর করতে-করতে ভূতটি তাঁর দিকে ক্যাঁট-ক্যাঁট করে তাকিয়ে রইল; তারপরে ঠিক করল একটা বড়ো কালো কুকুরের বেশ ধরবে সে। এই কাজে তার দক্ষতা সত্যিই ছিল অগাধ। কিন্তু সেই সময় তার দিকে এগিয়ে আসার পদশব্দ পেযেই সে তার সেই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা কার্যকরী করবে কিনা ভাবতে লাগল। সুতরাং সে ঈষৎ অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হয়েই সন্তুষ্ট হল; তারপরে গভীর একটা কবরখানার অতনাদ করেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঠিক সেই সময় যমজ দুটি ভাই কাছে এসে পড়ল।
নিজের ঘরে এসে সে একেবারে ভেঙে পড়ল। একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল তার মনের মধ্যে। যমজ ভাই দুটির অসভ্যতা, আর মিসেস ওটিসের জঘন্য বস্তুবাদ স্বাভাবিকভাবেই তার কাছে বড়োই বিরক্তিকর মনে হল। কিন্তু যেটা তার কাছে বিষম কষ্টদায়ক হল সেটা হচ্ছে এই যে সে বর্মটাকে পরতে পারল না। সে ভেবেছিল ভূত বর্ম পরে বসে রয়েছে এই দৃশ্য দেখে আধুনিক আমেরিকানেরও তাক লেকে যাওয়ার কথা। এর পেছনে অন্য কোনো সুবোধ্য কারণ না থাকলেও, তাদের ভাতীয় কবি লও ফেলোর সম্ভ্রমের জন্যেই তার চমকে যাওয়া উচিত ছিল। ক্যানটারভিলেরা যখন শহরে যেতেন তখন সারাদিনের মধ্যে একটি ক্লান্ত ঘন্টা সে নিজেও লও ফেলোর কবিতার বই-এর পাতা অনেকবার উলটিযেছে। কেনিলওয়ার্থ টুর্নামেন্টে সে নিজে এই বর্মটি বেশ সাফল্যের সঙ্গেই পরেছে; আর তাই দেখে অনূঢ় রানি। নিজেই তার কত প্রশংসা করেছেন। তবু আজ যখন সে সেই বর্মটি পরতে গেল তখন তার বিষম ভার বইতে না পেরে মেঝের ওপরে সে হুড়মুড় করে পড়ে গেল, পড়ে যাওয়ার ফলে তার ডান হাতের আঙুলের গাঁটগুলি হতবিহষ্কৃত হল; হাঁটুর ওপরে বসে যন্ত্রণায় সে কুকুরের মতো চিৎকার করে উঠল।