কিন্তু কোনো উত্তর এল না খুদে বামনটির কাছ থেকে।
রাগে গরগর করেত-করতে রাজকুমারী মাটিতে পা ঠকতে লাগল। এমন সময় চ্যামবারলেনের সঙ্গে মেকসিকো থেকে আসা নতুন সংবাদ পড়তে-পড়তে তার কাকা অলিন্দের উপর পায়চারি করছিল। সেইখানেই সেশনের ‘হোলি অফিস’ সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজকুমারী তার কাকাকে ডেকে বলল–আমার এই আমুদে বামনটা রাগ করে ঘুমোচ্ছে। আপনি ওকে তুলে দিয়ে আমার জন্যে নাচতে বলুন।
তারা নিজেদের মধ্যে একটু হাসাহাসি করল। তারপরে ঝুঁকে পড়ে তাঁর কারুশিল্প খচিত দস্তানা দিয়ে ডন পেড্রো তার গালে বিরাট একটা চড় কষিয়ে দিলেন–ওঠ; বেটা ওঠ। স্পেনের আর ইনডিস-এর রাজকুমারী তোর নাচ দেখতে চান। তোকে নাচতে হবে, বীভৎস জানোয়ার।
কিন্তু খুদে বামনটির কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
ডন পেড্রো ক্লান্তভাবে বললেন–চাবুক মাস্টারকে সংবাদ দিতে হবে।’ এই বলে তিনি অলিন্দের দিকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু চ্যামবারলেনকে বেশ গম্ভীর দেখা গেল। সে বামনটির পাশে হাঁটু মুড়ে বসল এবং তার বুকের উপরে হাতটা রাখল। কয়েক মুহূর্ত পরে কাঁধটা কুঁচকে সে দাঁড়িয়ে উঠে রাজকুমারীর সামনে মাথাটা একটু নুইয়ে বলল–আমার সুন্দরী রাজকুমারী, আপনার এই আমুদে বামনটি আর কোনোদিনই নাচবে না। রাজাকে হাসানোর মতো সে যে এতটা কুৎসিত হয়ে জন্মেছে এইটাই খুব দুঃখের কথা।
হাসতে-হাসতে রাজকুমারী জিজ্ঞাসা করল–কিন্তু ও আর নাচবে না কেন?
কারণ, তার হৃদয়টা ভেঙে গিয়েছে উত্তর দিল চ্যামবারলেন।
এই শুনে রাজকুমারী ভ্রূকুটি করল; তার সেই গোলাপের পাপড়ির মতো ওষ্ঠ-যুগল ঘৃণায় বিকৃত হয়ে উঠল। সে চিৎকার করে বলল–যার হৃদ্য আছে ভবিষ্যতে সে যেন আমার সঙ্গে খেলতে না আসে।
এই বলেই সে দৌড়ে বাগানের দিকে চলে গেল।
স্বার্থপর দৈত্য
The Selfish Giant
প্রতিদিন বৈকালে স্কুল থেকে ফিরে আসার পথে শিশুরা দৈত্যের বাগানে ঢুকে খেলা করত। বাগানটি বেশ বড়ো আর সুন্দর। নরম ঘাসে একেবারে বোঝাই। ঘাসের বনে এখানে-ওখানে নক্ষত্রের মতো সুন্দর-সুন্দর ফুল থাকত ফুটে। বাগানে ছিল বারোটা পিচ ফলের গাছ। বসন্তের সমাগমে সে-সব গাছে পাটুল বর্ণের আর মুক্তার মতো সাদা ধবধবে ফুল ফুটত শরতে ধরত ফল। গাছের ডালে বসে পাখিরা এমন মিষ্টি গান গাইত যে ছেলেরাও খেলা ভুলে গিয়ে তাদের গান শুনত। নিজেদের ভেতরে চিৎকার করে তারা বলাবলি করত–আমরা এখানে। খেলা করে কত সুখী হয়েছি।
একদিন সেই দৈত্য এসে হাজির। সে বেড়াতে গিয়েছিল তার বন্ধু কর্নিশ দৈত্যের বাড়িতে। সেখানে সাত বছর সে ছিল। কথাবার্তায় সে যে বিশেষ পটু ছিল তা নয়। তবু এই সাত বছরে যতটুকু আলাপ করা দরকার তা সে বন্ধুর সঙ্গে করেছে; তারপরে নিজের দুর্গে ফিরে আসতে
সে বদ্ধপরিকর হয়েছে। ফিরে এসেই সে দেখতে পেল ছেলেরা তার বাগানে খেলছে।
বেশ রাগত কণ্ঠেই সে জিজ্ঞাসা করল–তোমরা এখানে কী করছ হে?
এই কথা শুনেই ছেলেরা দৌড়ে পালিয়ে গেল সেখান থেকে।
দৈত্যটা বলল–আমার নিজের বাগান আমার নিজের সম্পত্তি। যে-কোনো মানুষই তা বুঝতে পারে। এখানে আমি কাউকে খেলা করতে দেব না; খেলব আমি কেবল নিজে।
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাগানের চারপাশে সে বিরাট একটা দেওয়াল তুলে দিল; তার ওপরে ঝুলিয়ে দিল একটা বিজ্ঞাপন–
বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে
দণ্ডণীয় হতে হবে
দৈত্যটি বড়োই স্বার্থপর!
বেচারাদের এখন আর কোথাও খেলার জায়গা নেই। তারা রাস্তার ওপরে খেলতে চেষ্টা করল কিন্তু ধুলো আর শক্ত পাথরকুচিতে রাস্তা একেবারে বোঝাই। রাস্তাটা তাদের ভালো লাগল না।
পড়াশুনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তারা ওই উঁচু দেওয়ালের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল–এর মধ্যে কত আনন্দেই না থাকতাম আমরা! তারপর বসন্ত এল। সারা অঞ্চল জুড়ে ছোটো-ছোটো ফুল আর পাখিতে গেল ভরে। কেবল সেই স্বার্থপর দৈত্যের বাগানে তখনো শীতকাল কাযেমি হয়ে রইল। সেখানে শিশুরা ছিল না বলে পাখিরা সেখানে গান গাইতে চাইল না, গাছেরা ভুলে গেল ফুল ফোঁটাতে। একবার একটি সুন্দর ফুল ঘাসের ভেতর থেকে মাথাটা তুলতেই ঝোলানো বিজ্ঞাপনটা তার চোখে পড়ল; সেই দেখে ছেলেদের জন্যে তার মনটা এতই খারাপ হয়ে গেল যে মাথাটা সে ঘাসের বনে লুকিয়ে সটান ঘুমিয়ে পড়ল। যারা সত্যিকারের খুশি হল তারা হচ্ছে বরফ আর কুয়াশা। তারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল–বসন্ত এই বাগানের কথা ভুলে গিয়েছে। সুতরাং সারা বছরই আমরা এখানে কাটিয়ে দেব। বরফের বিরাট সাদা আলখাল্লা দিযে ঘাসগুলিকে ঢেকে দিল। তারা। জমাট হিমকণা গাছগুলিকে রাঙিয়ে দিল সাদা রঙে। তারপরে তাদের সাহচর্য দেওযার জন্যে তারা আহ্বান জানাল উত্তর-বাতাসকে। উত্তর-বাতাস সাড়া দিল সেই ডাকে। পশমের আলখাল্লা জড়িয়ে সে সারাদিন বাগানের মধ্যে গর্ডন করে ঘুরে বেড়াল উডিযে ফেলে দিল চিমনিগুলিকে। সে খুশি হয়ে বলল–ডায়গাটা বড়ো চমৎকার। ঝা না ডাকলে আর চলছে না। সুতরাং ঝা এল। প্রতিদিন তিন ঘন্টা করে দুর্গের ওপরে সে নাচতে লাগল-ভেঙে ফেলল কাঁচের শার্সিগুলি। তারপর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে সে বাগানের মধ্যে দুটতে শুরু করল। পোশাক তার ধূসর রঙের নিঃশ্বাস তার বরফের মতো ঠাণ্ডা কনকনে।